মুনাফা নিয়ে বে-লিজিং’র লুকোচুরি
নিজস্ব প্রতিবেদক : পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক খাতের প্রতিষ্ঠান বে-লিজিং অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড ২০২১ সালের প্রথম নয় মাসে ৩৯ কোটি টাকা মুনাফা দেখিয়ে বছর শেষে এসে ১৪ কোটি টাকা লোকসান দেখিয়েছে । নয় মাসের মুনাফা দেখে যারা ভালো লভ্যাংশের আশায় এই শেয়ারে বিনিয়োগ করেছিলন তারা লোকসানে পড়েছেন সব দিক থেকেই।
পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞরা বে-লিজিং-এর এই হিসাবের খেলাকে বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে প্রতারণ বলছেন, পাশাপাশি এটাকে অব্যবস্থাপনা বলছেন। গতকাল বৃহস্পতিবার ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক খাতের প্রতিষ্ঠান বে-লিজিং তাদের ২০২১ সালের পুরো বছরের ফলাফল প্রকাশ করেছে, সেখানে দেখা যাচ্ছে তাদের শেয়ারপ্রতি লোকসান হয়েছে ৯৯ পয়সা অর্থাৎ তাদের মোট লোকসান হয়েছে ১৩ কোটি ৯৫ লাখ টাকা।
কিন্তু গত বছরের অক্টোবর মাসে যখন বে-লিজিং অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড তাদের প্রথম নয় মাসের মুনাফা ঘোষণা করেছিল, তখন তাদের শেয়ারপ্রতি মুনাফা ছিল ২ টাকা ৭৫ পয়সা। সে হিসাবে তাদের মোট মুনাফা ছিল ৩৮ কোটি ৭৪ লাখ টাকা। হিসাবে ৩৮ কোটি ৭৪ লাখ টাকার সঙ্গে আরো কিছু যোগ হয়ে বছর শেষের মুনাফা বাড়ার কথা ছিল।
কিন্তু সেটা তো বাড়েইনি বরং কোম্পানি লোকসানে চলে গেছে। এর কারণ হিসেবে বে-লিজিং বলেছে বছরের শেষ প্রান্তিকে এসে তাদের ৫৭ কোটি টাকার প্রভিশন রাখতে হয়েছে। আর্থিক খাতের প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে কোনো গ্রাহকের টাকা খেলাপি হওয়ার সম্ভাবনা থাকলে প্রভিশন রাখতে হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বে-লিজিং-এর কোম্পানি সচিব শারমিন আক্তার বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রভিশন রুল পরিবর্তন হয়েছে। আমাদের বড় কয়েকজন গ্রাহক সময়মতো টাকা দেননি শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের চাপে আমাদের প্রভিশন করতে হয়েছে।’
চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট স্নেহাশীষ বড়ুয়া বলেন, ‘নিয়ম হচ্ছে প্রতি কোয়ার্টারে প্রভিশন রাখতে হয়, একবারে বছর শেষে প্রভিশন রাখা এটা সঠিক নিয়ম নয়।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাপের বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে স্নেহাশীষ বড়ুয়া বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক যদি দেখে নিয়ম পরিপালন হচ্ছে না, সে তো চাপ দিবেই, প্রভিশন রাখা দরকার ছিল কিন্তু প্রভিশন রাখা হয়নি, বাংলাদেশ ব্যাংক সেটা করিয়েছে।’ বাংলাদেশ ব্যাংকের এই ক্ষেত্রে ভুল হতে পারে কি না এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘সেটা রেয়ার কেস।’
গত বছরের অক্টোবর মাসে যখন নয় মাসের মুনাফ ঘোষণা করেছিল বে-লিজিং, তার আগে এই কোম্পানির শেয়ারের দাম ছিল ২৭ টাকা। এরপর কয়েক দফায় বেড়ে এই কোম্পানির শেয়ারের দাম ৩৬ টাকা ৪০ পয়াসায় ওঠে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের ৮ তারিখে ৩৫ টাকা ২০ পয়সায় প্রায় ১ কোটি ২৪ লাখ শেয়ারের লেনদেন হয়। পরের দিন ৯ তারিখে ৩৬ টাকা ৪০ পয়সায় প্রায় ৮৬ হাজার শেয়ার লেনদেন হয়। এর পরেই এই শেয়ারের দামে ধস নামে। বর্তমানে শেয়ারটি ২৪ টাকার ঘরে লেনদেন হচ্ছে, যা আগের তুলনায় ১২ টাকা বা ৫২ শতাংশ কম। সে সময় বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগকারী এই শেয়ার বেশি দামে কিনেন পরে দাম বাড়ার আশায় ও ভালো লভ্যাংশ পাওয়ার আশায়। কিন্তু তাদের সবাইকেই বড় অঙ্কের লোকসান গুনতে হচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন্যান্স বিভাগের অধ্যাপক এম সাদিকুল ইসলাম বলেন, ‘এটা হচ্ছে বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে প্রতারণা আর অব্যবস্থাপনা। প্রভিশন প্রতি কোয়ার্টারে রাখতে হয় সেটা না রেখে ৯ মাসে ভালো মুনাফা দেখিয়ে বিনিয়োগকারীদের প্রলুব্ধ করা হয়েছে। তাদের বড় ক্ষতির মধ্যে ফেলা হয়েছে।’
বে-লিজিং ২০২১ সালে বিনিয়োগকরীদের জন্য ৫ শতাংশ স্টক লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা অনুমোদন দিলে তারা এই লভ্যাংশ দিতে পারবে। আগামী ৩০ অক্টোবর সাধারণ সভায় এবারের লভ্যাংশের অনুমোদন নিতে হবে। সে জন্য রেকর্ড ডেট ঠিক হয়েছে ৬ অক্টোবর। সেখানে অনুমোদন পেলে বে-লিজিং-এর ১০০টি শেয়ারের বিপরীতে বিনিয়োগকারীরা ৫টি করে শেয়ার পাবেন। ২০২১ সালে এ কোম্পানি প্রতি শেয়ারে ৯৯ পয়সা লোকসান করেছে, আগের বছর এপেক্স ট্যানারির শেয়ারপ্রতি মুনাফা ছিল ১ টাকা ১৪ পয়সা। এই সময়ে শেয়ারপ্রতি নগদ অর্থ প্রবাহ হয়েছে ঋণাত্মক ৪৮ পয়সা থেকে আগের বছর ছিল ৫ টাকা ৯৪ পয়সা। বছর শেষে শেয়ারপ্রতি নগদ সম্পদ মূল্য হয়েছে ১৭ টাকা ৮২ পয়সা, যা আগের বছর ১৯ টাকা ৮০ পয়সা ছিল। গতকাল বৃহস্পতিবার বে-লিজিং-এর শেয়ারের দাম কমেছে। গত বুধবার এপেক্স ট্যানারির শেয়ার বিক্রি হচ্ছিল ২৫ টাকা ৩০ পয়সায় । বৃহস্পতিবার দিন শেষে ১ টাকা ৪০ পয়সা কমে ২৩ টাকা ৯০ পয়সায় লেনদেন হচ্ছিল।
২০০৯ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত এ কোম্পানির শেয়ার বর্তমানে লেনদেন হচ্ছে ‘এ’ ক্যাটাগরিতে। ২০১৮ অর্থবছরে বে-লিজিং ২১ কোটি ৯৩ লাখ টাকা মুনাফা করেছিল; লভ্যাংশ দিয়েছিল শেয়ারপ্রতি ১ টাকা। ২০১৯ অর্থবছরে মুনাফা করে ১৫ কোটি ৪ লাখ টাকা। লভ্যাংশ দেয়া হয় ৭৫ পয়সা। এ ছাড়া প্রতি ১০০ শেয়ারে নতুন ২ দশমিক ৫০টি শেয়ার। ২০২০ অর্থবছরে মুনাফা করে ১৬ কোটি টাকা। লভ্যাংশ দেয়া হয় ১ টাকা । পুঁজিবাজারে এ কোম্পানির ১৪ কোটি ৮ লাখ ৮৮ হাজার শেয়ার রয়েছে। এর মধ্যে ৩০ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ আছে পরিচালকদের হাতে। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের হাতে আছে ২১ দশমিক ৪২ শতাংশ শেয়ার, বিদেশিদের হাতে আছে দশমিক ১৫ শতাংশ এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে রয়েছে ৪৮ দশমিক ৩৬ শতাংশ শেয়ার। বে-লিজিং অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের বর্তমান বাজার মূলধন ৩৫৬ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। পরিশোধিত মূলধন ১৪০ কোটি ৮৮ লাখ টাকা; রিজার্ভের পরিমাণ ১২৬ কোটি ৩ লাখ টাকা।