প্রান্তিক মানুষের ভাগ্য উন্নয়নে কাজ করছে ফ্রেন্ডশিপ
নিজস্ব প্রতিবেদক : বাংলাদেশে বঞ্চিত প্রান্তিক জনগোষ্ঠির ভাগ্য উন্নয়ন, তাদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত এবং দেশের উন্নয়নে অংশীদার হওয়ার লক্ষ্যে ২০০২ সালে যাত্রা করে সামাজিক সংস্থা ‘ফ্রেন্ডশিপ’। দেখতে দেখতে সফলতার সাথে ২০টি বছর পার করলো ফ্রেন্ডশিপ। এই ২০ বছরে নানা সীমাবদ্ধতা পেরিয়ে সামনে এগিয়ে চলার কথা জানাতে রাজধানীর ঐতিহ্যবাহী ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে আয়োজন করা হয় সংবাদ সম্মেলন। সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা নির্বাহী পরিচালক রুনা খান তুলে ধরেন ফ্রেন্ডশিপের সফলতার গল্পগুলো, যেখানে প্রান্তিক এলাকার প্রায় সাড়ে সাত লাখ বঞ্চিত মানুষ উপকৃত হচ্ছেন বিভিন্নভাবে।
যমুনা-ব্রহ্মপুত্রের প্রত্যন্ত চরে স্বাস্থ্যখাতের আমূল পরিবর্তনে ঘরবাড়ি হারা মানুষকে আধুনিক চিকিৎসা সেবার পথিকৃত ফ্রেন্ডশিপের ভাসমান হাসপাতাল। যেখানে প্রচলিত ব্যবস্থা কাজ করেনা এমন প্রত্যন্ত এলাকায় চালু করা হয়েছে মোবাইল স্বাস্থ্যসেবা এম-হেলথ। হাসপাতালের পাশাপাশি মোবাইল অ্যাপলিকেশন দিয়ে বাড়ীতে এবং স্যাটেলাইট ক্লিনিকে প্রশিক্ষিত মেডিক-এইডদের মাধ্যমে দেয়া হয় এই সেবা। লবণাক্ত এলাকায় ঝুঁকিতে থাকা মানুষের স্বাস্থ্য সেবায় সাতক্ষীরার শ্যামনগরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতাল। স্থপতি কাশেফ মাহবুব চৌধুরীর নক্সায় তৈরি হাসপাতাল স্থাপনাটি জয় করেছে বিশ্বখ্যাত রিবা অ্যাওয়ার্ড। কেবলমাত্র রোগীদের শারীরিক সুস্থতায় নয়, মানসিক প্রশান্তির জন্যও ডিজাইন করা হাসপাতালটির আঙিনা ও স্থাপনা। তাইতো ২০২১ সালে রিবা অ্যাওয়ার্ড জিতে নিয়েছে শ্যামনগর ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতাল।
মূল ভূখন্ড থেকে বিচ্ছিন্ন যমুনা-ব্রহ্মপুত্রের জনপদে মৌলিক অধিকার ও ন্যায় বিচার প্রাপ্তি সহজ করেছে ফ্রেন্ডশিপ ‘সুশাসন বিভাগে’র প্যারালিগ্যালবৃন্দ। প্রত্যন্ত চরে ফ্রেন্ডশিপ প্রতিষ্ঠা করেছে ৮০টি লিগ্যাল ইনফরমেশন বুথ বা আইনী তথ্য সেবা কেন্দ্র। পাশাপাশি চরের ৩ লাখ বাসিন্দাকে সাংবিধানিক ও মৌলিক অধিকার সম্পর্কে দেয়া হয়েছে আইনী প্রশিক্ষণ। ফলে চরাঞ্চলে সফলভাবে প্রতিরোধ করা যাচ্ছে বাল্য বিয়ে, যৌতুক, নারী নির্যাতন এবং পারিবারিক সহিংসতার মত ঘটনা। স্থানীয়দের আইনী সেবা নিশ্চিতে কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধা জেলা জজ আদালতে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে ফ্রেন্ডশিপ লিগ্যাল এইড বুথ। আইনী সেবার পাশাপাশি প্রান্তিক অঞ্চলে সচেতনতা বাড়াতে গান-নাটকের মাধ্যমে কাজ করে যাচ্ছে ফ্রেন্ডশিপ চর থিয়েটার। কক্সবাজার শরণার্থী এলাকায় শিশু-কিশোরদের মানবিক বিকাশে রয়েছে খেলাধুলার সুবিধাযুক্ত স্পোর্টস লাইব্রেরী। ফলে শরণার্থী এলাকায় রোহিঙ্গা এবং স্থানীয় শিশু-কিশোররা সুযোগ পাচ্ছে খেলাধুলার। স্পোর্টস লাইব্রেরীর মাধ্যমে দেয়া প্রশিক্ষণে জেলা পর্যায়ে ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন ভালুকিয়া পালং উচ্চ বিদ্যালয়।
যমুনা-ব্রহ্মপুত্র চরের ভাঙ্গা-গড়া স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। তাই সহজে স্থানাস্তর যোগ্য, সৌর বিদ্যুৎ চালিত এবং আইটি সুবিধাযুক্ত স্কুলের মাধ্যমে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে দুর্গম চরাঞ্চলে। উদ্দেশ্য, সবচেয়ে বিচ্ছিন্ন ও ঠিকানাহীন বাসিন্দাদের শিক্ষক হিসেবে গড়ে তোলা; যা ছিল কল্পনাতীত। ফ্রেন্ডশিপের সহযোগিতায় ২০১১ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত প্রাথমিক স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে ৫৩৮০ জন শিক্ষার্থী। এখানে পাশের হার শতভাগ। ২০ বছর আগে যেখানে স্কুলে পড়ার নিশ্চয়তা ছিল না, আজ সেখানে ‘ক্যারিয়ার গাইডেন্স সেল’ এর দেখানো স্কুলিং বা পাঠদান পদ্ধতি, চরের শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি এবং বৈশ্বিক ক্যারিয়ারে সৃষ্টি হয়েছে অভূতপূর্ব সুযোগ। তথ্য-প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে সুদূর ফ্রান্সের বিদ্যালয়ের সাথে অভিজ্ঞতা বিনিময় হচ্ছে চরের শিক্ষার্থীদের।
জলবায়ু পরিবর্তন, দুর্যোগ ও বন্যায় ভুক্তভোগিদের রক্ষায় চরে নির্মিত হয়েছে গুচ্ছগ্রাম। বন্যার পানি স্তর থেকে উঁচু ওভাল বা ডিম্বাকৃতি পুকুরের চারপাশ ঘিরে গড়ে ওঠা এ বসতি হচ্ছে স্থানীয়দের নিরাপদ আশ্রয় স্থল। এক একটি গুচ্ছগ্রামে বছরজুড়ে থাকতে পারে ২৫ থেকে ৩০টি পরিবার। আর দুর্যোগের সময় আশ্রয় নিতে পারে ৪’শর বেশি মানুষ। আবার দক্ষিণে উপকূলীয় এলাকায় ফ্রেন্ডশিপ নির্মিত ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্রকে বিভিন্নভাবে ব্যবহারের সুযোগও হচ্ছে স্থানীয়দের। র্যাম্প সুবিধাযুক্ত বিশেষ ডিজাইনের এ কনক্রিট স্থাপনা, ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছাসে উপকূলবাসীর জীবন ও সম্পদ রক্ষায় নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্র। উপকূলের লবনাক্ত এলাকায় স্থানীয় বাসিন্দাদের ব্যবস্থাপনায় গড়ে তোলা হয়েছে দেশের বৃহত্তম নার্সারী। এর উদ্দেশ্য ম্যানগ্রোভ বনায়নের মাধ্যমে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছাস থেকে উপকূলের জীব-বৈচিত্র রক্ষা করা।
সরকারের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ফ্রেন্ডশিপের অন্যতম প্রচেষ্টা সৌর বিদ্যুতের মাইক্রোগ্রীড। মোট ১৬২ কিলোওয়াটের ৩টি সৌর গ্রামে আলোকিত হচ্ছে চরের গ্রামগুলো। এভাবে বিদ্যুতের প্রত্যক্ষ সুবিধা পাচ্ছেন চরের ১৯,৬০২ জন বাসিন্দা। বিদ্যুতে পরোক্ষভাবে উপকৃত হচ্ছেন ৫,৪৮,০৮০ জন চরবাসী। এভাবে বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় বিচ্ছিন্ন জনপদের জীবনে এসেছে গতি। ফ্রেন্ডশিপের ‘টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়ন’ বিভাগের আওতায় ঋণের চক্র থেকে মুক্তি পাচ্ছে গরীব কৃষক ও জেলেরা। যেখানে ঋণ দাতাদের অর্থও ফেরত পেতে সহায়তা করা হয়। আবার আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর জ্ঞান আদান-প্রদানে উদ্যোক্তা কৃষকদের নিয়ে গঠিত হয়েছে কৃষক ক্লাব।
কারিগরদের পৃষ্টপোষকতা করে দেশের ঐতিহ্যবাহী নৌকা তৈরি শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার প্রয়াসে কাজ করে যাচ্ছে ফ্রেন্ডশিপের ‘কনটিক’। এর অধীনে ঐতিহ্যবাহী কাঠের তৈরি পাল তোলা নৌকার ছোট প্রতিলিপি তৈরি ও সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। পাশাপাশি নদী ভ্রমনের সুযোগ রয়েছে ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন মালার (বি৬১৩) নৌকায়। দেশের পর্যটনকে এগিয়ে নিতে বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের সাথেও কাজ করছে ফ্রেন্ডশিপ।
সংবাদ সম্মেলনের পর, যৌতুক, বাল্য বিবাহ, মৌলিক অধিকারের মত বিষয় নিয়ে মনোজ্ঞ নাটক প্রদর্শন করেন ফ্রেন্ডশিপ চর থিয়েটারের শিল্পীবৃন্দ। এর পাশাপাশি একই ভেন্যুতে আয়োজন করা হয় বিশেষ প্রদর্শনী। যেখানে বাংলার ঐতিহ্যবাহী বিভিন্ন নৌকার রেপ্লিকা, চরবাসী’র উৎপাদিত পোষাক ও হাতে তৈরি পণ্য সৌখিন সামগ্রী প্রদর্শিত হয়।
অনুষ্ঠানে যোগ দেন ফ্রেন্ডশিপ বাংলাদেশের বোর্ড অব চেয়ার সালাহউদ্দিন আহমেদ, ফ্রেন্ডশিপ ইন্টারন্যাশনালের কো-চেয়ার মার্ক এলভিনগারসহ বিভিন্ন দেশে কর্মরত ফ্রেন্ডশিপ ইন্টারন্যাশনালের বোর্ড সদস্য ও জেষ্ঠ্য কর্মকর্তারা।
ফ্রেন্ডশিপ সম্পর্কে:
যেখানে জীবন-জীবিকা হুমকিতে, সেসব প্রন্তিক এলাকার জনগোষ্ঠিকে স্বাবলম্বী করা এবং স্থানীয় জনগনের ক্ষমতায়ন নিয়ে কাজ করছে উন্নয়ন সহযোগি সংস্থা ‘ফ্রেন্ডশিপ’। ২০০২ সালে যাত্রা শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত প্রতিবছর লাখ লাখ মানুষকে সহযোগিতা করে আসছে সংস্থাটি। দুর্গম প্রত্যন্ত এলাকার পাশাপাশি যেখানকার বাসিন্দারা জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার এমন জনগোষ্ঠিকে স্বাবলম্বী করতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সংস্থাটি। এক্ষেত্রে সফলতার মডেল হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে ফ্রেন্ডশিপ। সংস্থার আছে ৩ হাজারের বেশি কর্মচারী, যাদের ৫০ ভাগ স্থানীয় বাসিন্দা। ফ্রেন্ডশিপের আছে আন্তর্জাতিক শক্তিশালী নেটওয়ার্ক ও দৃষ্টিভঙ্গি, যেখানে মানুষের আশা ও মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকার সমান সুযোগ থাকে।