ব্যাংকখাতে তিন মাসে ঋণ পুনঃতফসিল বেড়েছে ৫০%
নিজস্ব প্রতিবেদক : বিদায়ী বছরের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকগুলো তাদের খেলাপি থাকা গ্রাহকের ঋণ পুনঃতফসিল করেছে ৫৫৫১ কোটি টাকা; যা আগের (এপ্রিল-জুন) প্রান্তিকের তুলনায় প্রায় ৫০ শতাংশ বেশি।
জুন প্রান্তিকে এর পরিমাণ ছিল ৩৭০৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ পুনঃতফসিল বেড়েছে ১৮৪৫ কোটি টাকা।
ব্যাংকাররা বলেন, নতুন করে ব্যাংকগুলোর বোর্ডের পুনঃতফসিল ক্ষমতা পাওয়া ও পুনঃতফসিল করতে সুদ হার কম থাকার পাশাপাশি খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ায় পুনঃতফসিলের পরিমাণ বেড়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের এপ্রিল থেকে জুন এই সময়ে রাষ্ট্রমালিকানাধীণ ব্যাংকগুলো ৮৮৫ কোটি টাকা পুনঃতফসিল করেছে। বেসরকারি ব্যাংকগুলো করেছে ৪৫২৪ কোটি টাকা, বিশেষায়িত ব্যাংকগুলো করেছে ১৭ কোটি টাকা।
গত ২০২০-২১ সাল জুড়ে ঋণ পরিশোধে অবারিত ছাড় পেয়েছেন খেলাপি গ্রাহকরা। যার কারণে নিয়ন্ত্রণে ছিল খেলাপি ঋণ। ঋণ পরিশোধের নীতিছাড়ের মেয়াদ ২০২২ এ শেষ হতেই খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়তে শুরু করে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, বিদায়ী ২০২২ এর শুরুতে ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৩২৭৩ কোটি টাকা। জুন শেষে এর পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা। এছাড়া সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ আরও বেড়ে দাঁড়ায় ১ লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা বলেন, ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়তে থাকায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পুনঃতফসিলের আবেদন বাড়তে থাকে। তাই সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের গ্রাহকের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে প্রত্যেক ব্যাংকের বোর্ডকে পুনঃতফসিল করার সুযোগ দিয়েছে।
গত জুলাইয়ে নতুন এ সুবিধা দেওয়া হয়। তার আগে বিশেষ সুবিধায় ঋণ নিয়মিত করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন লাগত। তবে জাল-জালিয়াতি ও অনিয়ম-প্রতারণার ঋণ নতুন নীতিমালার আওতায় নিয়মিত করা যাবে না বলে জানিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
নতুন নিতিমালায় খেলাপি ঋণ নিয়মিত করতে এখন ২.৫ থেকে সাড়ে ৪ শতাংশ অর্থ জমা দিলেই চলবে। আগে ঋণ নিয়মিতকরণের জন্য দিতে হতো ১০ থেকে ৩০ শতাংশ অর্থ।
এ ধরনের ঋণ পরিশোধে আগে সর্বোচ্চ দুই বছর সময় দেওয়া হলেও এখন তা বাড়িয়ে পাঁচ থেকে আট বছর নির্ধারণ করা হয়েছে।
এ বিষয়ে বেসরকারি একটি ব্যাংকের এমডি বলেন, “এখন ব্যাংকগুলো তারল্য সংকটে রয়েছে। একইসঙ্গে খেলাপি ঋণ বাড়ছে। তাই ব্যাংকগুলো তাদের ঋণ পুনঃতফসিল করে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমাচ্ছে। এর মধ্যে ঋণ স্বাভাবিক হলেও কিছু তারল্য ব্যাংকের নতুন যোগান হবে। যা ব্যাংকগুলোর জন্য এই মুহূর্তে খুবই প্রয়োজন।”
পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউটের এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর ড. আহসান মনসুর বলেন, “যখন কোন গ্রাহকের ঋণ দীর্ঘদিন খেলাপি থাকে সেই ঋণ পুনঃতফসিল করা ব্যাংকগুলোর জন্য প্রয়োজন। একইসঙ্গে আসল পেতে হলে কিছুটা সুদ মওফুফ করতে হয়। তবে চতুরতার মাধ্যমে কিছু প্রভাবশালী গ্রাহক এর সুযোগ নিচ্ছে।”
২০২০ সালে কোভিডের বছরে কোন খেলাপি ঋণ না থাকলেও, সেবছরে ঋণ পুনঃতফসিল হয়েছে ১৩৪৬৮ কোটি টাকা। ২০২১ সালে গ্রাহকরা ঋণ পুনঃতফসিল করেছে ১২৩৮০ কোটি টাকা। বিদায়ী বছরের নয় মাসে (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর) ঋণ পুনঃতফসিল করেছে ১১৫১৫ কোটি টাকা।
যদিও এযাবৎকালে সবচেয়ে বেশি ঋণ পুনঃতফসিল হয়েছে ২০১৯ সালে। নীতিমালা অনুযায়ী, মাত্র ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্টে ৯ শতাংশ সরল সুদে এক বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ ১০ বছরে ঋণ পরিশোধের সুযোগ দেওয়া হয় সেসময়। যার কারণে ওই বছর ৫০৪৩৪ কোটি টাকা ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের রিপোর্ট বলছে, চলতি বছরের (এপ্রিল-জুন) প্রান্তিকে ব্যাংকগুলো তাদের গ্রাহকের ২৫৯৫ কোটি টাকা সুদ মওকুফ করেছে। এর মধ্যে বেসরকারি ব্যাংকগুলো সুদ মওকুফ করেছে ২৫৫৭ কোটি টাকা।
তবে ২০২২ এর (জুলাই-সেপ্টেম্বর) মেয়াদে ব্যাংকগুলো সুদ মওকুফ করেছে ৩৫০ কোটি টাকা। এরমধ্যে বেসরকারি ব্যাংকেগুলোর সুদ মওকুফ ছিল ২১২ কোটি টাকা।
এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিপোর্টে দেখা যায়, দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক কার্যক্রম স্বাভাবিক অবস্থায় থাকাকালীন ২০১৯ সালে ব্যাংকগুলো ঋণের সুদ মওকুফ করেছে ২২৯৩ কোটি টাকা।
কোভিডের বছর ২০২০ সালে ১৫৭৮ কোটি টাকা সুদ মওকুফ হয়। ২০২১ সালে ব্যাংকগুলো ১৮৫৫ কোটি টাকা ঋণের সুদ মওকুফ করে। যদিও বিদায়ী বছরের নয় মাস শেষেই ব্যাংখগুলো ৩১৬৬ কোটি টাকা ঋণের সুদ মওকুফ করেছে।