বাংলাদেশের কারখানাগুলোকে উৎপাদন খরচের চেয়ে কম মূল্য দিয়েছে ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলো: গবেষণা
নিজস্ব প্রতিবেদক : বিশ্বজুড়ে সুপরিচিত ও প্রধান হাই স্ট্রিট ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলো বাংলাদেশের কারখানাগুলোকে তাদের উৎপাদন খরচের চেয়ে কম মূল্য দিয়েছে বলে দাবি করেছেন গবেষকরা। বাংলাদেশের ১০০০টি কারখানার মধ্যে জরিপ চালিয়ে দেখা গেছে, বেশিরভাগ কারখানাতেই দুই বছর আগে করোনার পূর্বে তারা পোশাকের যে মূল্য পেতেন; করোনার পর কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি পাওয়া সত্ত্বেও তাদেরকে সেই আগের মূল্যই দেওয়া হয়েছে, খবর বিবিসির।
এছাড়াও, প্রতি পাঁচটির মধ্যে একটি কারখানা মালিক জানিয়েছেন, বাংলাদেশে শ্রমিকদের জন্য নির্ধারিত ন্যূনতম দৈনিক মজুরি ২.৩০ পাউন্ড দিতেই তারা হিমশিম খেয়েছেন।
স্কটল্যান্ডের আবারডিন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজনেস স্কুল ও জাস্টিস চ্যারিটি ট্রান্সফর্ম ট্রেড যৌথভাবে এ গবেষণাটি পরিচালনা করেছে। তাদের প্রতিবেদনে ২০২০ সালের মার্চ থেকে ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়টায় কারখানাগুলোর পরিস্থিতি নিয়ে কাজ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বড় বড় হাই স্ট্রিট ব্র্যান্ডগুলোর মধ্যে যারা চারটি বা তার অধিক কারখানার কাছ থেকে পোশাক কেনে, এদের ৯০ শতাংশই অসাধু ক্রয় প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত ছিলেন। এর মধ্যে রয়েছে- অর্ডার বাতিল করা, ন্যায্য পারিশ্রমিক দিতে ব্যর্থতা, পারিশ্রমিক দিতে দেরি করা এবং ডিসকাউন্ট (ছাড়) চাওয়া। আর বিদেশি ক্রেতাদের এসব কর্মকান্ডের ফলে দেশের কারখানাগুলোতে শ্রমিকদের জোরপূর্বক ওভারটাইম করানো ও হেনস্থার মতো সমস্যা তৈরি হয়।
এদিকে একাধিক রিটেইলার এই প্রতিবেদনের দাবিগুলোকে অস্বীকার করেছেন।
আবারডিন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাসটেইন্যাবিলিটি একাউন্টিং অ্যান্ড ট্রান্সপারেন্সি বিভাগের অধ্যাপক মুহম্মদ আজিজুল ইসলাম এ গবেষণাটির নেতৃত্ব দিয়েছেন। তিনি বলেন, “মহামারি শুরু হওয়ার পর থেকে দুই বছরে বাংলাদেশি গার্মেন্ট শ্রমিকদেরকে তাদের জীবনধারণের জন্য পর্যাপ্ত পারিশ্রমিক দেওয়া হয়নি। প্রতি পাঁচজন কারখানা মালিকের মধ্যে একজন তার শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি দিতে সংগ্রাম করেছেন। অন্যদিকে ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলো বাংলাদেশের শ্রমকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের মুনাফা বৃদ্ধি করেছে।”
মুহম্মদ আজিজুল ইসলাম মনে করেন, বিশ্বজুড়ে মুদ্রাস্ফীতির হার বৃদ্ধির ফলে এ পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যেতে পারে। তিনি জানান, পণ্য সরবরাহকারীদের ভাষ্যমতে- বাংলাদেশের বিভিন্ন কারখানা থেকে পোশাক ক্রয়কারী বড় বড় ব্র্যান্ডগুলো ছোট ব্র্যান্ডগুলোর তুলনায় প্রায়শই অসাধু ক্রয় প্রক্রিয়ায় জড়িত ছিল।
বাংলাদেশে মোট রপ্তানি আয়ের ৮৫ শতাংশই আসে তৈরি পোশাক শিল্প থেকে। বর্তমানে দেশের ১২ মিলিয়নেরও বেশি মানুষের জীবন-জীবিকা এই খাতের ওপর নির্ভরশীল।
গবেষণায় আরও দেখা গেছে, মহামারির পর বাংলাদেশের কারখানাগুলো তাদের আগের শ্রমিকদের মধ্যে মাত্র ৭৫ শতাংশ শ্রমিক নিয়োগ দিতে পেরেছে; অর্থাৎ সেসময় প্রায় ৯০০,০০০ শ্রমিক তাদের চাকরি হারিয়েছেন।
অধ্যাপক আজিজুল ইসলাম তার জীবনের ১৭ বছর কাটিয়েছেন বাংলাদেশের পোশাক কারখানাগুলোর শ্রমিকদের জীবন-জীবিকা নিয়ে গবেষণা করে। তিনি বেড়ে উঠেছেন ঢাকায়, যেখানে অসংখ্য পোশাক শ্রমিকের বাস। অধ্যাপক মনে করেন, যুক্তরাজ্যের নীতিনির্ধারকরা তার এ গবেষণার ফলাফলের দিকে নজর দেবেন।
অধ্যাপক আজিজুল ইসলাম বলেন, “রিটেইলাররা তাদের প্রতিবেদনে বলে যে শ্রমিকদের প্রতি তাদের কিছু অঙ্গীকার আছে এবং তাদের অগ্রগতি হয়েছে। কিন্তু এই খাতে স্বচ্ছতা রক্ষা করা একটি বড় সমস্যা এবং নির্দিষ্ট কোনো পণ্য এথিক্যালি উৎপাদিত (শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার বজায় রেখে) হচ্ছে কিনা তা প্রমাণ করা কঠিন।”
গবেষণার আরেক সহযোগী, ট্রান্সফর্ম ট্রেড এর ফিওনা গুচ এ গবেষণাকে ‘সতর্ক বার্তা’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। সংবাদমাধ্যম বিবিসিকে তিনি বলেন, “রিটেইলাররা যখন শর্তভঙ্গের মাধ্যমে পণ্য সরবরাহকারীদের সাথে খারাপ আচরণ করে, তখন এর ফল ভোগ করতে হয় শ্রমিকদের। কোনো রিটেইলার যদি চুক্তি অনুযায়ী পারিশ্রমিক দিতে ব্যর্থ হয় কিংবা পারিশ্রমিক দিতে দেরি করে, তখন সরবরাহকারীকে যেকোনো উপায়ে নিজের খরচ কমিয়ে আনতে হয়; আর বেশিরভাগ সময়ই সেই চাপটা শ্রমিকদের ওপরেই পড়ে। কারণ সরবরাহ চেইনে এই শ্রমিকদের ক্ষমতা থাকে সবচেয়ে কম।”
তিনি আরও যোগ করেন, “বিদ্যামান সুপারমার্কেট ওয়াচডগের মতোই, যুক্তরাজ্যের গার্মেন্ট রিটেইলারদের নিয়ন্ত্রণের জন্য আমাদের একটি ফ্যাশন ওয়াচডগ থাকা দরকার।”
গত বছরের জুলাইয়ের ক্রস পার্টির সমর্থনযোগে একটি ‘ফ্যাশন সাপ্লাই চেইন’ সংসদীয় বিল পেশ করা হয়েছিল। বিশ্বজুড়ে সরবরাহকারীদের ও যুক্তরাজ্যের পোশাক রিটেইলারদের মধ্যে ন্যায্য ক্রয় প্রক্রিয়া তদারকির জন্য একটি ওয়াচডগ প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল এতে।