ডলার সংকটের প্রভাব
ক্যাপিটাল মেশিনারি ও শিশু খাদ্য আমদানিতে এলসি ওপেনিংয়ে ব্যাপক পতন
শাহ আলম নূর : দেশে চলছে ডলার সংকট। এতে প্রভাব পড়েছে ক্যাপিটাল মেশিনারি ও শিশু খাদ্য আমদানিতে। এদুটি পণ্য আমদানিতে এলসি ওপেনিংয়ে ঘটেঠে ব্যাপক পতন।
সংশ্লিষ্ঠরা বলছেন বেসরকারি ব্যাংকগুলোর এলসি খোলার পরিমাণ খুবই কম। কারণ তারা এই সময়ে এলসি খোলার চেয়ে ডলার সংগ্রহে বেশি নজর দিচ্ছে। এছাড়া ইন্টারন্যাশনাল মার্কেটে পণ্যের দাম বৃদ্ধি ও ডলারের দাম বাড়ার কারণে পণ্যের তুলনায় আমদানি ব্যয় বেশি হচ্ছে। আগে যে পণ্য ১০০ টাকায় কেনা যেত, এখন প্রায় ১২০ টাকা লাগছে। যার কারণে বিভিন্ন ধরণের পণ্য আমদানির পরিমাণ কম।
তারা বলছেন ডলার সংকটে লেটার অব ক্রেডিট (এলসি) ওপেনিং এ বাড়তি সময় লাগা, রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে তৈরি হওয়া গ্যাস সংকটে রপ্তানিকারক দেশের উৎপাদন সীমিত হয়ে যাওয়ার প্রভাবে বেবি মিল্কের (ইনফ্যান্ট ফর্মুলা) সরবরাহ সংকট তৈরি হয়েছে।
দেশের বিভিন্ন খাতের ব্যবসায়িদের সাখে কথা বলে জারা যায় দেশে ডলারের সংকট ও বৈশ্বিক বাণিজ্যিক অস্থিরতার কারণে ক্যাপিটাল মেশিনারি, শিল্পের কাঁচামাল, ইন্টারমিডিয়েট গুডস ও কনজ্যুমার গুডস তথা ভোগ্যপণ্য আমদানিতে ব্যাপক পতন হয়েছে।
চলতি অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে ক্যাপিটাল মেশিনারির আমদানি দাঁড়ায় ১.২৭ বিলিয়ন ডলারে, যা ২০২১-২২ অর্থবছরের একই সময়ে আমদানি হওয়া ৩.৬৭ বিলিয়ন ডলারের ৬৫.৩২% কম।
একইসঙ্গে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বরে ভোগ্যপণ্য ও শিল্পের কাঁচামাল আমদানি হয়েছে ৪.১২ ও ১.২০ বিলিয়ন ডলার। যা ২০২১-২২ অর্থবছরে ক্রমান্বয়ে ছিল ৪.৬৯ ও ১.৬৫ বিলিয়ন ডলার।
ব্যাংকাররা বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বৈদেশিক বাণিজ্য অস্থিরতার মধ্যে রয়েছে। বিদেশি বায়ারদের দেশ থেকে পোশাক আমদানির চাহিদা কমে গেছে। একইসঙ্গে দেশের ব্যাংকগুলোতে ডলারের সংকট থাকায় ব্যবসায়ীরা চাহিদা থাকলেও আমদানি করতে পারছে না। যার কারণে সকল ধরণের আমদানির পরিমাণ কমেছে।
চলতি অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বরের মধ্যে ইন্টারমিডিয়েট গুডস আমদানি হয়েছে ২.৫৮ বিলিয়ন ডলার। যা আগের বছরে একই সময়ে ছিল ৩.৮৭ বিলিয়ন ডলার। সে হিসেবে চলতি অর্থবছরের এই সময়ে ইন্টারমিডিয়েট গুডস আমদানি কমেছে ৩৩.১৮%।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র এবং নির্বাহী পরিচালকদের অন্যতম মেসবাহুল হক বলেন, “আমাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ছাড়া অপ্রয়োজনীয় আমদানি কমানোর একটা প্রচেষ্টা চলমান রয়েছে। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে দেশের উৎপাদনে ক্যাপাসিটি এনহ্যান্সমেন্ট কমে আসবে।”
“উৎপাদনকারীরা উৎপাদন বাড়াতে চাইলেই ক্যাপিটাল মেশিনারির আমদানি বাড়ে। সামনে কী হতে যাচ্ছে এটা কেউ বলতে পারছে না। যার ফলে ক্যাপিটাল মেশিনারি ও ইন্ড্রাস্টিয়াল র’ ম্যাটারিয়াল আমদানি কমেছে।”
তিনি বলেন, “গত বছর আমাদের যে পরিমাণে ক্যাপাসিটি এনহ্যান্সমেন্ট হয়েছে সেই পরিমাণ অর্ডার পূরণ করাই আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত বছরের ন্যায় এবছরও ক্যাপিটাল মেশিনারিজ আমদানির চাহিদা নেই। আমাদের বিশ্ব পরিস্থিতির সঙ্গে তাল মিলিয়েই চলতে হবে।”
গত বছরের এপ্রিল থেকে মূল্যস্ফীতি, ডলারের বাজার স্থিতিশীল রাখা এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতন ঠেকাতে পণ্য আমদানিতে লাগাম দেয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা। একের পর এক নির্দেশনা জারি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আমদানিতে নানা শর্তের কারণে ২০২২ (জুলাই-ডিসেম্বর) পর্যন্ত এলসি ওপেনিং কমেছে প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার। যদিও কেন্দ্রীয় ব্যাংক এলসি ওপেনিংয়ের প্রভিশনাল তথ্যে এই সময়ে দেখিয়েছে যে, প্রায় ১২ বিলিয়নের মধ্যে এলসি ওপেনিং কমেছে।
২০২১ সালের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে এলসি ওপেনিং হয় ৪৪.০১ বিলিয়ন ডলার, ২০২২ এর একই সময় এলসি ওপেনিং হয় ৩৪.১০ বিলিয়ন ডলার।
এদিকে বিদায়ী ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশের ব্যাংকগুলোর কাছে ৭.৬ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করতে হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। যা ছিল যেকোন অর্থবছরের তুলনায় সর্বোচ্চ। তবে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই-জানুয়ারির ১৯ তারিখ পর্যন্ত প্রায় ১০ বিলিয়নের বেশি ডলার বিক্রি করতে হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র বলেন, “গত অর্থবছরের অনেক এলসি পেমেন্ট ডেফার্ড ছিল। যার বড় পরিমাণে পেমেন্ট চলতি অর্থবছরের মধ্যে করতে হয়েছে। আশা করছি এখন এলসি সেটেলমেন্টের পরিমাণ কমে আসবে। যা গত কয়েকমাস যাবত দেখছি।”
তিনি আরও বলেন, “আমাদের রেমিট্যান্সের পরিমাণ বাড়ছে, একইসঙ্গে রপ্তানির পরিমাণও বাড়ছে। আশা করা যাচ্ছে সামনের সময়ে ডলার বিক্রির পরিমাণ কমে আসবে।”
সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ২০২৩ এর জানুয়ারি-জুন সময়ের মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়, চলতি অর্থবছর শেষে দেশের রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়াবে ৩৬.৫ বিলিয়ন ডলার।
১৮ জানুয়ারি পর্যন্ত রিজার্ভ কমে দাঁড়িয়েছে ৩২.৪৭ বিলিয়ন ডলার। যদিও ২০২১ এর আগস্টে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৪৮ বিলিয়ন ডলার।
একাধিক ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের কর্মকর্তারা বলেন, বেসরকারি ব্যাংকগুলোর এলসি খোলার পরিমাণ খুবই কম। কারণ তারা এই সময়ে এলসি খোলার চেয়ে ডলার সংগ্রহে বেশি নজর দিচ্ছে। এছাড়া ইন্টারন্যাশনাল মার্কেটে পণ্যের দাম বৃদ্ধি ও ডলারের দাম বাড়ার কারণে পণ্যের তুলনায় আমদানি ব্যয় বেশি হচ্ছে। আগে যে পণ্য ১০০ টাকায় কেনা যেত, এখন প্রায় ১২০ টাকা লাগছে। যার কারণে বিভিন্ন ধরণের পণ্য আমদানির পরিমাণ কম।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলেন, প্রায় ২০টির বেশি ব্যাংকে ডলারের ব্যাপক সংকট রয়েছে। এর মধ্যে অনেক ব্যবসায়ীরা কনজ্যুমার ও ইন্টারমিডিয়েট গুডস আমদানির জন্য এলসি খুলতে চাচ্ছে। তবে ব্যাংকগুলোতে ডলার না থাকায় তারা এলসি খুলতে পারছে না।
এদিকে শিশু খাদ্য আমদানিকারক ও বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, বাজারে চাহিদার তুলনায় পণ্যটির সরবরাহ কমে গেছে। আমদানিতে খরচ বেড়ে যাওয়ার কারণে বেবি মিল্কের দামও বেড়েছে।
শিশু খাদ্য বা বেবি মিল্কের বাজারে ৫০ শতাংশের বেশি বাজার দখলে আছে নেসলে বাংলাদেশের। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কোম্পানিটির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, “অবস্থা এমন হয়েছে যে, এলসি খোলার সমস্ত ডকুমেন্ট রেডি কিন্তু ডলার সংকটের কারণে এটা সেটেল করা যাচ্ছে না। এ কারণে আগে যে স্মুথ সরবরাহ চেইন ছিল, সেটা নষ্ট হয়ে গেছে।”
আমদানিকারকরা বলছেন, বাংলাদেশ ব্যাংক খুব বেশি স্ক্রুটিনি করে দেখছে কোন পণ্যটা আনা দরকার, আর কোনটা দরকার নেই। তারপর এলসি খোলার অনুমতি দিচ্ছে। এ কারণে এলসি খোলার ক্ষেত্রে সময় অনেক বেশি লাগছে।
এলসি জটিলতা এবং রপ্তানিকারক দেশগুলোর সরবরাহ পরিস্থিতি ধীরগতির হওয়ার কারণে আমদানিও ধীরগতির হয়েছে। আবার সময় বেশি লাগার কারণে বাড়তি খরচও হচ্ছে। এসব কারণে বাজারে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের বেবি মিল্কের দামও বেড়েছে দফায় দফায়।
সুপারশপ স্বপ্ন, মিনা বাজারসহ কারওয়ানবাজারের বেশ কয়েকটি শপ ঘুরে দেখা গেছে, ৪০০ গ্রাম ওজনের বেবি মিল্কের একটি টিনের কৌটা কিনতে এখন ব্র্যান্ডভেদে সর্বোচ্চ ৭৫০ টাকা ব্যয় করতে হচ্ছে। সরবরাহকারীরা বলছেন, ২০২০ সালেও এই দাম ছিল ৫০০ টাকার মধ্যে।
কারওয়ানবাজারের মুদি দোকান আল-আমিন ট্রেডার্সের বিক্রেতা আলমগীর হোসেন বলেন, “একদিকে দাম বেশি, অন্যদিকে সরবরাহ কম। যেগুলোর চাহিদা বেশি, সেগুলো অর্ডার দেওয়ার এক মাস পরেও সরবরাহ করা হচ্ছে।”
বেবি মিল্কের বাজারজাতের জন্য পাবলিক হেলথ নিউট্রিশন ইন্সটিটিউটের অনুমতি নেওয়ার দরকার পড়ে। এখন পর্যন্ত ১৭টি প্রতিষ্ঠান এই অনুমতির জন্য আবেদন করেছে। তবে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, দেশে বর্তমানে ৯-১২টি ব্র্যান্ডের বেবি মিল্ক বাজারে পাওয়া যায়। বার্ষিক ১০ হাজার মেট্রিক টন বেবি মিল্কের চাহিদা রয়েছে দেশের বাজারে।
আমদানিকারকরা বলছেন, ডলার সংকটের কারণে সব ব্যাংক এলসি খুলতে পারছে না। আবার রপ্তানিকারক দেশগুলোতেও সংকট তৈরি হয়েছে। রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ইউরোপের দেশগুলোতে গ্যাসের সংকট তৈরি হয়েছে। একটা নির্দিষ্ট টাইমের পর কোন কোম্পানি গ্যাস ব্যবহার করতে পারছে না।
আবার নির্ধারিত সময়ের বাইরে কোন কোম্পানি যদি গ্যাস ব্যবহার করতে চায় তবে সেটা চড়া দাম দিয়ে কিনতে হচ্ছে। এতে করে কোম্পানিগুলোর উৎপাদনও কমে গেছে। এতে তাদের সরবরাহও অনেকটা সংকুচিত হয়েছে। ফলে তারাও নির্দিষ্ট পরিমাণের পণ্য সরবরাহ করতে আগের চেয়ে বেশি সময় নিচ্ছে। সবমিলে এসব পণ্য দেশে আসতে সময় লাগতো ৩ মাস, সেখানে এখন লাগছে ৮ মাস।
আমদানিকারকদের তথ্য বলছে, ২০২২ সালে আমেরিকার দুটি বড় বেবি মিল্ক প্রস্তুতকারী কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। যে কারণে তারাও এখন ইউরোপের দেশগুলো থেকে বেবি মিল্ক কেনার পরিমাণ বাড়িয়েছে। তাছাড়া চীন সংকটের শঙ্কায় চাহিদার চেয়ে বেশি দুধ কিনছে। ফলে একদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদা বেড়েছে, অন্যদিকে সরবরাহ কমে গেছে। এর প্রভাবে দেশেও সরবরাহ সংকট তৈরি হয়েছে।
ইনফ্যান্ট অ্যান্ড ইয়াং চিলড্রেন নিউট্রিশন অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ইফতেখার রশিদ বলেন, “ডলার সংকটের কারণে এলসি খুলতে সমস্যা হচ্ছে। আবার রাশিয়া-ইউক্রেন যদ্ধের প্রভাবে ইউরোপে তৈরি হওয়া গ্যাস সংকটে বেবি মিল্কের উৎপাদন কম হচ্ছে, আবার নতুন বায়ার তৈরি হয়েছে। যে কারণে সরবরাহ চেইনে সংকট তৈরি হয়েছে।”
এ প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারাও জানান, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে ইন্টারন্যাশনাল প্রোডাকশন কমে যাওয়া, ডলার ক্রাইসিস, এলসি জটিলতার কারণে বেবি মিল্কের আমদানির পরিমাণ কমেছে। তবে কর্মকর্তারা এটাকে শঙ্কা হিসেবে না দেখে সম্ভাবনা হিসেবে দেখেতে চান। সরবরাহ সংকট তৈরি হলে বেবি মিল্কের ওপর নির্ভরতা থেকে সরে এসে বাধ্য হয়েই অনেক মা তার শিশুকে বুকের দুধ খাওয়াবে, যা শিশুর পুষ্টিতে ভুমিকা রাখবে।
গত ১৫ জানুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার বলেছিলেন, “আমাদের অপ্রয়োজনীয় অনেক এলসি হয়েছে। এছাড়া আমদানির মাধ্যমে অনেক ওভার ইনভয়েসিং ও আন্ডার ইনভয়েসিং হয়েছে। এখন আমরা সকল আমদানিতে খুব নজরদারি করছি, এতে ওভার ও আন্ডার ইনভয়েসিং অনেকটাই কমেছে।”