চালের মজুতে ঘাটতি না থাকলেও কমছেনা দাম
শাহ আলম নূর : দেশের সরকারি গুদামগুলোতে খাদ্যশস্যের মজুত পর্যাপ্ত থাকলেও কমছেনা চালের দাম। দেশে চালের উৎপাদন, বিপণন, গুদামে মজুত, আমদানি সবকিছুতেই এবার রেকর্ড হয়েছে। চাহিদার তুলনায় খাদ্য উদ্বৃত্ত রয়েছে। এরপরও গত বছরের তুলনায় এবার দাম অনেক বেশি।
সরকারি গুদামগুলোতে খাদ্যশস্যের মজুত বেড়ে ১৯ লাখ মেট্রিক টনে উঠেছে। অভ্যন্তরীণ ধান-চাল সংগ্রহ এবং চাল আমদানির ওপর ভর করে বাড়ছে এই মজুত। কিন্তু তার পরও বাজারে চালের দাম কমছে না; উল্টো বাড়ছে। সপ্তাহ দুয়েক আগে দেশে চালের দাম কেজিতে ৩-৪ টাকা কমলেও গত সপ্তাহে তা ফের বেড়ে আগের অবস্থানে উঠেছে।
সরকারি বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য বলছে, গতকাল রোববার রাজধানীর বাজারগুলোতে ৪৬ থেকে ৫২ টাকা কেজি দরে মোটা চাল বিক্রি হয়েছে। এক বছরের ব্যবধানে দাম বেড়েছে ৩ দশমিক ১৬ শতাংশ। আর সরু চাল (মিনিকেট-নাজিরশাইল) বিক্রি হয়েছে ৫৮ থেকে ৭৫ টাকা কেজি দরে। এক বছরে বেড়েছে ৪ শতাংশ।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের দৈনিক খাদ্যশস্য পরিস্থিতি প্রতিবেদনে দেখা যায়, গতকাল দেশে মোট খাদ্যশস্য মজুতের পরিমাণ ছিল ১৯ লাখ ৯৪ হাজার ৩৬৬ টন। এর মধ্যে চালের মজুত হচ্ছে ১৫ লাখ ৩০ হাজার ৬৯৮ টন। গম ৩ লাখ ৬২ হাজার ১০৪ টন; আর ধান ২ হাজার ৩৫৩ টন।
অতীতের তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, গত বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে এই মজুত ২০ লাখ টন ছাড়িয়ে গিয়েছিল, যা ছিল রেকর্ড। বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনোই সরকারিভাবে এত খাদ্যশস্য মজুত ছিল না। কিন্তু এর পর থেকে কমতে কমতে সেই মজুত মে মাস শেষে ১২ লাখ ৫২ হাজার টনে নেমে আসে। এরই মধ্যে এপ্রিল থেকে দেশে বোরো ধান ও চাল সংগ্রহ অভিযান শুরু করে সরকার। আমদানিও বাড়িয়ে দেয়। এর ফলে আবার বাড়তে থাকে খাদ্যের মজুত; আমন সংগ্রহ অভিযান এবং চাল আমদানি বাড়ায় এখন ১৯ লাখ টন হয়েছে।
বর্তমান মজুতকে ‘সন্তোষজনক’ উল্লেখ করে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়, অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে আমন সংগ্রহ কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সব মিলিয়ে ২ লাখ ২৪ হাজার ৯৫১ টন খাদ্যশস্য সংগ্রহ করা হয়েছে। এর মধ্যে ১ লাখ ১ হাজার ৬১০ টন ধান, ৪ লাখ ৫১ হাজার ৫৩ হাজার ১৫০ টন চাল এবং ২ হাজার ২০৪ টন ধান সংগ্রহ করা হয়েছে।
নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও দেশে এবার আমনের বাম্পার ফলন হয়েছে। আমনের ফলনের চূড়ান্ত হিসাব এখনো প্রকাশ করেনি সরকার। তবে কৃষি মন্ত্রণালয় প্রাথমিক হিসাব দিয়ে বলেছে, এবার ১ কোটি ৭০ লাখ টন আমন ধান উৎপাদন হবে। গত বছর প্রকৃত উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ১ কোটি ৪৯ লাখ টন। এবার দেশে ৫৯ লাখ হেক্টর জমিতে আমন উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলেও উৎপাদন হয়েছে ৫৯ লাখ ৫৬ হাজার হেক্টর জমিতে; অর্থাৎ প্রায় ৫৬ হাজার হেক্টর বেশি জমিতে আমনের চাষাবাদ হয়েছে। গড় ফলন হেক্টরে ৩ দশমিক ১১৯ টন।
আমনের বাম্পার ফলনের পরও বাজারে চালের দাম কমছে না কেন- এ প্রশ্নের উত্তরে কৃষি অর্থনীতিবিদ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘চালের দাম আসলে অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করে। কৃষক তো আর সরাসরি বাজারে চাল বিক্রি করেন না। বড় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলো কৃষকদের কাছ থেকে ধান কিনে সেই ধান থেকে চাল করে বাজারে বিক্রি করে। এ ক্ষেত্রে সিন্ডিকেটের ঘটনা ঘটে, কারসাজি করে চালের দাম বাড়িয়ে দেয়া হয়। সরকার বাজার ভালোভাবে মনিটর না করার কারণেই চালের দাম কমছে না।’
তিনি বলেন, ‘বোরো মৌসুমের প্রস্তুত শুরু হয়ে গেছে। বীজতলার কাজ প্রায় শেষ। কয়েক দিনের মধ্যেই চাষাবাদ শুরু হবে। আগামী এপ্রিল-মে মাসে বোরো ধান উঠবে। আমনের মতো বোরো ভালো হলে আগামী এক বছর খাদ্য নিয়ে আর চিন্তা করতে হবে না। তবে দাম সহনীয় রাখার জন্য সরকারের তদারক ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে।’
জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘মজুত বেড়েছে, এটা ভালো। কিন্তু দাম কেন বাড়ছে, সেটার কারণ খুঁজে বের করতে হবে। এ ক্ষেত্রে কেউ কারসাজি করে বা সিন্ডিকেট গড়ে তুলে দাম বাড়িয়ে দিয়ে থাকলে তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। উৎপাদন বাড়বে; মজুত বাড়বে। দাম কমবে না- এটা মেনে নেয়া যায় না।’
গতকাল রাজধানীর কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা গেছে, বাজারে চালের সরবরাহে কোনো ঘাটতি নেই। নতুন চালও প্রচুর এসেছে। কিন্তু দাম কমছে না। রাজধানীর শেওড়াপাড়া বাজারের একটি মুদি দোকানে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ভালো মানের সরু চাল বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৭৪ থেকে ৮০ টাকা; এক মাস আগেও এই একই দামে চাল বিক্রি হয়েছিল। মাঝে ২-৩ টাকা কমেছিল। গত সপ্তাহে তা আবার বেড়ে আগের দামে বিক্রি হচ্ছে। এই বাজারের এক মুদি দোকানের মালিক রিপন বলেন, ‘বাজারে মোটা চাল আগের দামেই বিক্রি হচ্ছে। তবে কয়েক দিনে ৩-৪ টাকা বেড়েছে।’
বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাসকিং মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক লায়েক আলী বলেন, ‘ধানের দাম বেশি। সে কারণে চালের দাম কমছে না।’
খাদ্য মজুত বাড়াতে চাল ও গম আমদানি বেড়েই চলেছে। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের সাড়ে ছয় মাসে (২০২২ সালের ১ জুলাই থেকে চলতি বছরের ১৮ জানুয়ারি) সব মিলিয়ে ২২ লাখ ৭২ হাজার ৩৬০ টন খাদ্য (চাল ৭ লাখ ৮০ হাজার ২৭০ টন এবং গম ১৪ লাখ ৯২ হাজার ৯০ টন) আমদানি হয়েছে। এর মধ্যে সরকারিভাবে ৮ লাখ ৬৪ হাজার ৫০ হাজার টন এবং বেসরকারিভাবে ১৪ হাজার ৭ লাখ ৮৬০ টন খাদ্য আমদানি হয়েছে।
গত ২০২১-২২ অর্থবছরের পুরো সময়ে (১২ মাস, জুলাই-জুন) মোট ৪৯ লাখ ৯৯ হাজার ৫৩০ টন খাদ্য (চাল ৯ লাখ ৮৭ হাজার ৪১০ টন ও গম ৪০ লাখ ১২ হাজার ১২ টন) আমদানি হয়েছিল।
দাম লাগামের মধ্যে রাখতে নিম্নআয়ের জনগোষ্ঠীকে মূল্য সহায়তা প্রদান এবং বাজার স্থিতিশীল রাখতে ২০১২ সালে ওএমএস ব্যবস্থা চালু করে সরকার। এ ব্যবস্থায় বর্তমানে দেশব্যাপী ডিলারদের দোকান ও খোলা ট্রাকের মাধ্যমে প্রতি কেজি চাল ৩০ টাকা ও আটা ২৪ টাকা দরে বিক্রি করা হচ্ছে। একজন ক্রেতা একবারে সর্বোচ্চ পাঁচ কেজি করে চাল ও আটা কিনতে পারেন।
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি এবং করোনা বিধিনিষেধের মধ্যে চাপে আছে প্রায় সব শ্রেণি-পেশার মানুষ। এ পরিস্থিতিতে শ্রমজীবী ও নিম্নআয়ের মানুষের জন্য ওএমএসের আওতা বৃদ্ধি এবং দেশে খাদ্যশস্যের বাফার মজুত কিছুটা হলেও ক্রেতা-ভোক্তার জন্য স্বস্তিদায়ক হবে বলে মনে করছেন দেশে ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান। তিনি বলেন, ‘খোলাবাজারে চাল-আটা বিক্রি (ওএমএস) কার্যক্রম জোরদার হলে বাজারে ওই পণ্যগুলোর মূল্য নিয়ন্ত্রণে থাকবে। যার সুফল ভোক্তারা পাবেন।’ তিনি বলেন, ‘বাজার পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে সরকারি গুদামে নিরাপত্তা মজুত হিসেবে অন্তত ১০ লাখ টন চাল থাকতে হয়। এর বাড়তি থাকা আরও ভালো। খাদ্যশস্যের বর্তমান