অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাব
ভ্যাট আদায় কমছে বড় কোম্পানিগুলো থেকে
শাহ আলম নূর : অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাবে ভ্যাট আদায় কমছে বড় কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে। এলটিইউ কর্তৃক সংগৃহীত ভ্যাটের অর্ধেকেরও বেশি আসে দুটি তামাক কোম্পানি থেকে – ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ (এ খাতের বৃহত্তম করদাতা) এবং ইউনাইটেড ঢাকা টোব্যাকো কোম্পানি লিমিটেড। এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, গত ছয় মাসে এই দুই কোম্পানি থেকে রাজস্ব আদায় বেড়েছে ৬ শতাংশের কিছু বেশি। মোবাইল টেলিকম খাতের কোম্পানিগুলোর ভ্যাট প্রবৃদ্ধি ৪ শতাংশের নিচে। বীমা খাতের ছয়টি কোম্পানি এবং কয়েকটি ব্যাংকও নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি দেখিয়েছে।
অন্যদিকে, ২০টি ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির মধ্যে ছয়টি নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি দেখিয়েছে এবং চারটি কোম্পানি নামমাত্র প্রবৃদ্ধি দেখিয়েছে।
চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে বড় কোম্পানিগুলো থেকে রাজস্ব আদায়ের প্রবৃদ্ধি কমেছে। এর কারণ হিসেবে নীতিগত সমস্যা ও অর্থনৈতিক মন্থরতাকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞ ও ব্যবসায়ীরা।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের লার্জ ট্যাক্সপেয়ার্স ইউনিট (এলটিইউ) তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে দেশের ১০৭টি বড় কোম্পানি থেকে মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) সংগ্রহ সামগ্রিকভাবে বেড়েছে ৯.৭%; যা ২০২১-২২ অর্থবছরের একই সময়ের মধ্যে প্রায় ১৩% ছিল।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক সদস্য ফরিদ উদ্দিন বলেন, “বড় করদাতাদের ভ্যাট সংগ্রহে প্রায় ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ঘটেছে, এর কারণ মূলত পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি এবং মূল্যস্ফীতি। এটা স্বাভাবিক প্রবৃদ্ধি নয়।”
চলতি অর্থবছরের শুরুতে সরকার দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৭.৫% নির্ধারণ করেছিল, যা ২০২২ এর ডিসেম্বরে সংশোধন করে ৬.৫% নির্ধারণ করা হয়। তবে বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ অনুমান অনুসারে, ২০২৩ অর্থবছরে দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৫.২%।
“আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম বৃদ্ধি এবং স্থানীয় মুদ্রার অবমূল্যায়নের কারণে ভ্যাট আদায় বেড়েছে। তবে প্রবৃদ্ধি বেশি হবে বলে আশা করা হয়েছিল, যা দেশের অর্থনৈতিক অবনতির কারণে হয়নি।” ফরিদ উদ্দিন মো.
“মানুষের আয় ও ভোগের প্রবণতা কমেছে, সেইসাথে বিনিয়োগও। ফলে যে পরিমাণ প্রবৃদ্ধি হওয়া দরকার ছিল তা হয়নি,” যোগ করেন তিনি।
রাজস্ব সংগ্রহের প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রার সাথে মেলেনি- স্বীকার করে এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনীম সাম্প্রতিক একটি অনুষ্ঠানে বলেন, দেশের অভ্যন্তরের কারণগুলোর পরিবর্তে আন্তর্জাতিক কারণগুলোই প্রবৃদ্ধি কমার জন্য দায়ী।
তবে গ্যাস সেক্টরসহ কিছু খাত থেকে ভ্যাট আদায়ে অস্বাভাবিক প্রবৃদ্ধি হয়েছে, মূলত শুল্ক বৃদ্ধিই এ প্রবৃদ্ধির কারণ।
এদিকে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি পেট্রোবাংলা চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে ভ্যাট পরিশোধে ৫৪% প্রবৃদ্ধি দেখিয়েছে।
চলতি অর্থবছরে এনবিআরের সামগ্রিক ভ্যাট আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা প্রায় ১,৩৭,০০০ কোটি টাকা, যার মধ্যে প্রথমার্ধে সংগ্রহ করা হয়েছে ৫৩,০০০ কোটি টাকার কিছু বেশি।
অন্যদিকে, এ অর্থবছরের জন্য এলটিইউ-ভ্যাট অফিসের লক্ষ্যমাত্রা ৬৬ হাজার কোটি টাকারও বেশি। কিন্তু এখন পর্যন্ত তারা তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলো থেকে প্রায় ২৭ হাজার ২৬৫ কোটি টাকা সংগ্রহ করেছে।
সংশ্লিষ্টদের মতে, লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য আগামী মাসে অনেক বেশি হারে রাজস্ব আদায় করতে হবে, যা বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে কার্যত অসম্ভব।
এলটিইউ কর্তৃক সংগৃহীত ভ্যাটের অর্ধেকেরও বেশি আসে দুটি তামাক কোম্পানি থেকে – ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ (এ খাতের বৃহত্তম করদাতা) এবং ইউনাইটেড ঢাকা টোব্যাকো কোম্পানি লিমিটেড।
এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, গত ছয় মাসে এই দুই কোম্পানি থেকে রাজস্ব আদায় বেড়েছে ৬ শতাংশের কিছু বেশি। মোবাইল টেলিকম খাতের কোম্পানিগুলোর ভ্যাট প্রবৃদ্ধি ৪ শতাংশের নিচে। বীমা খাতের ছয়টি কোম্পানি এবং কয়েকটি ব্যাংকও নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি দেখিয়েছে।
অন্যদিকে, ২০টি ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির মধ্যে ছয়টি নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি দেখিয়েছে এবং চারটি কোম্পানি নামমাত্র প্রবৃদ্ধি দেখিয়েছে।
বড় কোম্পানিগুলোর কর্মকর্তাদের মতে, প্রত্যাশিত হারে ভ্যাট আদায় না হওয়ার পেছনে অর্থনৈতিক মন্দা ছাড়াও কয়েকটি নীতি দায়ী।
ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো (ব্যাট) বাংলাদেশের এক্সটার্নাল অ্যাফেয়ার্সের প্রধান শেখ সাবাব আহমেদ বলেন, “বাজেট-পরবর্তী সময়ে চোরাচালান করা তামাক ব্র্যান্ডের বিস্তারের পাশাপাশি অত্যধিক শুল্ক বৃদ্ধির কারণে প্রিমিয়াম এবং উচ্চ-স্তরের সেগমেন্টে হওয়া ভলিউম লসের কারণে ভ্যাট প্রবৃদ্ধি কমেছে।”
“স্পষ্টতই, আমরা ভলিউম হারাচ্ছি, অন্যদিকে সিগারেট চোরাচালানের জন্য রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। বাজার সমীক্ষা থেকে আমরা অনুমান করছি, এই ব্র্যান্ডগুলোকে অবিলম্বে বাধা না দিলে চলতি অর্থবছরে প্রায় ৭০০ কোটি টাকার রাজস্বকে প্রভাবিত করতে পারে তারা,” বলেন তিনি।
ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশের পর এলটিইউকে সবচেয়ে বেশি ভ্যাট দেয় গ্রামীণফোন। কিন্তু অর্থবছরের প্রথমার্ধে কোম্পানিটির ভ্যাট প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র ১ শতাংশের বেশি।
গ্রামীণফোনের যোগাযোগ প্রধান খায়রুল বাশার বলেন, “২০২২ সালের জুন থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সিম বিক্রির উপর নিষেধাজ্ঞা থাকায় জাতীয় অর্থনীতিতে গ্রামীণফোনের অবদান কমে গেছে।”
এছাড়া মানুষ মোবাইল ফোনে ব্যয় কমিয়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রে ব্যয় বাড়িয়েছে, যা এ খাত থেকে ভ্যাট কমানোর অন্যতম কারণ বলেও জানান তিনি।
রবি আজিয়াটা লিমিটেডের ভ্যাট প্রদানে প্রবৃদ্ধি ১০%। রবির রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্সের প্রধান শাহেদ আলম বলেছেন, অর্থনৈতিক দুরাবস্থা না থাকলে প্রবৃদ্ধি প্রায় ১৪% হতো।
এদিকে, যে ছয়টি বীমা কোম্পানি এলটিইউকে ভ্যাট দেয়, তাদের সম্মিলিত ভ্যাট সংগ্রহ আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় এ বছর প্রায় ৫% কমেছে।
বাংলাদেশ জেনারেল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী অফিস আহমেদ সাইফুদ্দিন চৌধুরী বলেন, “যেহেতু লেটার অব ক্রেডিট (এলসি) খোলার হার কমেছে, তাই এই খাত থেকে ভ্যাট আদায় কমেছে।”
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, ১০৭টি বড় কোম্পানির মধ্যে ২১টি এই অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি দেখিয়েছে এবং ১৭টি প্রান্তিক প্রবৃদ্ধি দেখিয়েছে। তাদের প্রবৃদ্ধি শূন্য থেকে ৬% এর মধ্যে।
ভ্যাট প্রদানে নেতিবাচক বা কম প্রবৃদ্ধির তালিকায় রয়েছে ইউনাইটেড ঢাকা টোব্যাকো লিমিটেড, পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড, বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ড, লিন্ডে বাংলাদেশ লিমিটেড, বাংলালিংক, টেলিটক বাংলাদেশ লিমিটেড এবং স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক লিমিটেড। তবে সিমেন্ট খাতে নয়টি কোম্পানির সম্মিলিত ভ্যাট প্রবৃদ্ধি প্রায় ৬১%।
সিমেন্ট শিল্প সূত্রে জানা গেছে, অর্থবছরের প্রথমার্ধে কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি এবং আমদানি ভ্যাট ভালো হওয়াই এই প্রবৃদ্ধির কারণ।