স্বল্পোন্নত দেশগুলো করুণা চায় না : প্রধানমন্ত্রী
নিজস্ব প্রতিবেদক : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, স্বল্পোন্নত দেশগুলো করুণা বা দাক্ষিণ্য চায় না। বরং আন্তর্জাতিক প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী তাদের ন্যায্য পাওনা চায়।
সদ্য সমাপ্ত কাতার সফর নিয়ে সোমবার (১৩ মার্চ) বিকেল সাড়ে ৪টায় গণভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী এ কথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সফরে কোভিড অতিমারি ও চলমান ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট বিশ্বব্যাপী খাদ্য, জ্বালানি ও আর্থিক সঙ্কটের পরিপ্রেক্ষিতে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য নেওয়া বিভিন্ন আন্তর্জাতিক অঙ্গীকার অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাস্তবায়নের দাবি জানিয়েছি। এক্ষেত্রে আমি আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, বিনিয়োগ, আর্থিক সহায়তা, বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ, প্রযুক্তি হস্তান্তর, নিরাপদ অভিবাসন, জলবায়ু অর্থায়ন প্রাপ্তি ইত্যাদি বিষয়ে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর বিশেষ প্রয়োজনের কথা তুলে ধরি।
এছাড়া বাংলাদেশসহ উত্তরণের পথে থাকা দেশগুলোর উন্নয়ন অর্জনকে গতিশীল রাখতে বর্ধিত সময়ের জন্য এলডিসিদের জন্য প্রযোজ্য অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য সুবিধাসহ অন্যান্য সুবিধা অব্যাহত রাখার আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাত ধরে ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে জাতিসংঘের সদস্য দেশের স্বীকৃতি পায়। তার দেখানো পথ অনুসরণ করেই আমাদের সরকার জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে ২০২১ সালের মধ্যে আমাদের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী একটি মধ্যম আয়ের উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে উত্তরণের সব মাপকাঠি পূরণ করতে সক্ষম হয়।
বাংলাদেশ ও কাতারের সম্পর্ককে ঢেলে সাজানোর আহ্বান
বাংলাদেশ ও কাতারের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে পারস্পরিক লাভজনক অর্থনৈতিক অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে ঢেলে সাজানোর আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি দু’দেশের সরকারের মধ্যে একটি যৌথ ব্যবসা ও বিনিয়োগ কমিটি এবং দু’দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী সংগঠনের সমন্বয়ে একটি যৌথ বিজনেস ফোরাম গঠনের প্রস্তাব করেছি। এছাড়া আমি নবায়নযোগ্য জ্বালানি, সামুদ্রিক গ্যাস অনুসন্ধান, জ্বালানি সঞ্চালন ব্যবস্থা, কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ, পর্যটন, স্টার্ট আপসহ বিভিন্ন খাতে কাতারের ব্যবসায়ীদের বাংলাদেশে বিনিয়োগের আহ্বান জানাই।
তিনি বলেন, আমি আমাদের প্রতিনিধি দল আয়োজিত একটি সাইড ইভেন্টে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলাম। ইভেন্টে মিশর, সিঙ্গাপুর, এস্তোনিয়ার মন্ত্রী পর্যায়ের প্রতিনিধি, জাতিসংঘের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারা অংশগ্রহণ করেন। এ সময় তারা আমাদের সরকারের ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ বাস্তবায়নে অর্জিত সফলতার প্রশংসা করেন এবং আমাদের রূপকল্প-২০৪১ অনুযায়ী ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ বিনির্মাণে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দিয়ে পাশে থাকার আশ্বাস দেন।
শেখ হাসিনা বলেন, আমি ১৯৯৬ সালে আমার সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে কৃষি গবেষণা উৎসাহিত করা, ২০০৯ সাল থেকে দেশব্যাপী মজবুত ও নিরাপদ ডিজিটাল অবকাঠামো গড়ে তোলা এবং একইসঙ্গে স্বাস্থ্য, জলবায়ু পরিবর্তন, জৈব প্রযুক্তি ইত্যাদি খাতে গবেষণা ও উদ্ভাবন উৎসাহিত করার লক্ষ্যে বিজ্ঞানসম্মত শিক্ষা, বৃত্তি, অনুদান প্রচলনসহ নানাবিধ উদ্যোগের কথা তুলে ধরি।
একই দিন সন্ধ্যায় আমি জিসিসিভুক্ত দেশ ইরাক, জর্ডান, লেবানন ও তুরস্কে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতদের নিয়ে আয়োজিত আঞ্চলিক দূত সম্মেলনে অংশগ্রহণ করি। সম্মেলনে আমি জাতির পিতার অনুসৃত পররাষ্ট্রনীতির ধারাবাহিকতায় মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের নতুনতর দিগন্ত উন্মোচনের লক্ষ্যে সমন্বিত পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশনা দিই। এসব দেশের সঙ্গে রপ্তানি প্রসার, বিনিয়োগ আকর্ষণ, জ্বালানি নিরাপত্তা, প্রবাসীদের স্বার্থ ও অধিকার সুরক্ষা, প্রযুক্তি সহযোগিতাসহ অর্থনৈতিক কূটনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্ব দেওয়ার জন্য আমাদের রাষ্ট্রদূতদের নির্দেশনা দেই। একইসঙ্গে প্রয়োজন অনুযায়ী ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে কনস্যুলার সেবার পরিসর বৃদ্ধি করার পরামর্শ দিয়েছি।
ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে চলমান আলোচনা অব্যাহত রাখার আহ্বান
ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর সঙ্গে চলমান আলোচনা অব্যাহত রাখার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সফরে আমি মিয়ানমারে দ্রুত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন এবং কক্সবাজার থেকে ভাসানচরে আরও রোহিঙ্গাদের স্থানান্তরের বিষয়ে জাতিসংঘের সহযোগিতা চাই।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান জ্বালানির চাহিদা মেটাতে কাতার বাংলাদেশের পাশে থাকবে বলে বৈঠকে কাতারের আমির আমাকে আশ্বাস দেন
বাংলাদেশে প্রাথমিক স্তরে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের সহায়তার লক্ষ্যে কাতার ফান্ড ফর ডেভেলপমেন্ট-এর সঙ্গে ১২.৭ মিলিয়ন ডলার অনুদান সম্পর্কিত একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয় বলেও উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী।
এছাড়া প্রধানমন্ত্রী বাণিজ্য, বিনিয়োগ, শিল্পায়ন, যোগাযোগ অবকাঠামো, ডিজিটাল প্রযুক্তিসহ বিভিন্ন খাতে সরকারের নেওয়া বিভিন্ন সুদূরপ্রসারী কর্মকাণ্ডের কথা উল্লেখ করেন। তিনি উত্তরণ-পরবর্তী সময়ে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য প্রযোজ্য শুল্ক ও কোটামুক্ত বাণিজ্য সুবিধা এবং ওষুধ শিল্পসহ অন্যান্য খাতের স্বার্থে ট্রিপস অব্যাহতি বজায় রাখার আহ্বান জানান।
অভিবাসনে ইচ্ছুকদের প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক থেকে প্রয়োজনীয় অর্থ সহায়তা নিয়ে বৈধপথে বিদেশ গমন, হুন্ডির পরিবর্তে ব্যাংক বা মানি ট্রান্সফার এজেন্সির মাধ্যমে দেশে রেমিটেন্স প্রেরণ এবং অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড থেকে দূরে থেকে স্বাগতিক দেশের আইনকানুন মেনে চলার জন্য প্রবাসীদের অনুরোধ জানান প্রধানমন্ত্রী।
সবশেষে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতিসংঘ সম্মেলনে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ তার লক্ষ্য অর্জন করতে পেরেছে বলে আমি মনে করি। এ সম্মেলনে আমরা রূপকল্প ২০৪১ বাস্তবায়নের পথে এলডিসি থেকে উত্তরণ ও এসডিজি অর্জনের লক্ষ্যে আমাদের গৃহীত বিভিন্ন প্রস্তুতি ও কার্যক্রম সম্পর্কে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অবহিত করেছি। স্বল্পোন্নতদেশগুলোর পক্ষ থেকেও আমরা ‘দোহা প্রোগ্রাম অব অ্যাকশনে’ আমাদের জন্য প্রযোজ্য বিষয়গুলো বাস্তবায়নের বিষয়ে অঙ্গীকার করেছি। আমরা আশা করবো, এই অ্যাকশনে জাতিসংঘের আওতায় সাস্টেনেবল গ্রাজুয়েশন সাপোর্ট ফ্যাসিলিটি স্থাপনের ব্যাপারে যে উদ্যোগের কথা বলা হয়েছে তা যথাযথভাবে এগিয়ে যাবে।