চীনা মুদ্রায় রাশিয়ার ঋণ পরিশোধ করবে বাংলাদেশ
আন্তর্জাতিক ডেস্ক : রাশিয়ার কাছ থেকে ঋণ নিয়ে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে বাংলাদেশে। কিন্তু রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকায় মার্কিন ডলারে তা পরিশোধ করা সম্ভব নয়। আর তাই রাশিয়ার এই পারমাণবিক কেন্দ্রের ঋণ চীনা মুদ্রায় পরিশোধ করবে বাংলাদেশ।
এমনকি চীনা মুদ্রা ব্যবহার করে অর্থ পরিশোধের জন্য প্রয়োজনীয় অনুমোদনও দিয়েছে বাংলাদেশ। স্থানীয় সময় সোমবার (১৭ এপ্রিল) এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে প্রভাবশালী মার্কিন সংবাদমাধ্যম ওয়াশিংটন পোস্ট।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চীনের মুদ্রা ইউয়ান ব্যবহার করে রাশিয়ান পারমাণবিক কেন্দ্র নির্মাণকারীকে ৩১৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের অর্থ পরিশোধের অনুমোদন দিয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশি একজন কর্মকর্তার বরাত দিয়ে এই তথ্য সামনে এনেছে সংবাদমাধ্যমটি।
আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে অর্থ পরিশোধের জন্য মার্কিন ডলারকে বাইপাস করে চীনা মুদ্রা ব্যবহার করা দেশগুলোর মধ্যে এটিই সর্বশেষ ঘটনা বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
মার্কিন এই সংবাদমাধ্যমটি বলছে, গত বৃহস্পতিবার বাংলাদেশের অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের এক সভায় ঋণ পরিশোধের জন্য চীনা মুদ্রা ইউয়ান ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে মন্ত্রণালয়ের ইউরোপীয় বিষয়ক শাখার প্রধান উত্তম কুমার কর্মকার ওয়াশিংটন পোস্টকে জানিয়েছেন।
উত্তম কুমার কর্মকার বলেছেন, ঋণ পরিশোধের জন্য চীনা মুদ্রা ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও লেনদেন এখনও সম্পূর্ণ হয়নি। কারণ অর্থপ্রদানের বিবরণ আরও স্পষ্ট ও সমাধান করা দরকার। বিষয়টির কূটনৈতিক সংবেদনশীলতার কথা উল্লেখ করে তিনি এ বিষয়ে আর কোনও মন্তব্য করতে রাজি হননি বলে জানিয়েছে ওয়াশিংটন পোস্ট।
এদিকে বাংলাদেশ ও রাশিয়ার মধ্যে এক বছরেরও বেশি সময় ধরে অর্থ পরিশোধের বিষয়ে যে অচলাবস্থা চলছে, ঢাকার এই সিদ্ধান্তের তার সমাধান হবে বলে মনে হচ্ছে। ইউক্রেনে সামরিক অভিযান পরিচালনা করার কারণে গত বছর বিশ্বের অন্যতম পেমেন্ট সিস্টেম সোসাইটি ফর ওয়ার্ল্ডওয়াইড ইন্টারব্যাংক ফাইন্যান্সিয়াল টেলিকমিউনিকেশনস বা সুইফট থেকে রাশিয়াকে বাদ দেয় পশ্চিমা দেশগুলো।
মার্কিন নিয়ন্ত্রিত আন্তর্জাতিক এই অর্থ স্থানান্তর ব্যবস্থায় প্রবেশে রাশিয়াকে নিষিদ্ধ করার পর থেকে বাংলাদেশ ডলার ব্যবহার করে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য রাশিয়াকে কোনও অর্থ পরিশোধ করতে পারেনি।
ওয়াশিংটন পোস্ট বলছে, রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়ে তোলার জন্য রাশিয়ার কাছ থেকে প্রাপ্ত ১২ বিলিয়ন ডলারের ঋণের অর্থ পরিশোধ করতে বাংলাদেশ এখন ক্রস-বর্ডার ইন্টারব্যাংক পেমেন্ট সিস্টেম (সিআইপিএস)-এর মাধ্যমে ইউয়ান ব্যবহার করবে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে মার্কিন ডলারের আধিপত্য রুখতে ২০১৫ সালে চীন এই সিস্টেমটি তৈরি করেছিল।
এছাড়া রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের দায়িত্বে নিয়োজিত রাশিয়ান কন্ট্রাক্টর রোসাটম স্টেট অ্যাটমিক এনার্জি কর্পোরেশনের একজন প্রতিনিধি ঋণ পরিশোধের জন্য ইউয়ান ব্যবহার করার পরিকল্পনার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তবে বিষয়টির সংবেদনশীলতার কারণে নিজের নাম প্রকাশ না করার শর্ত রেখেছেন তিনি।
অন্যদিকে চীনা অনলাইন নিউজ আউটলেট সিনা গত সোমবার জানিয়েছে, পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অর্থ পরিশোধের জন্য চীনা মুদ্রা ইউয়ান সবচেয়ে কার্যকর বিকল্প হবে বলে একজন বাংলাদেশি কর্মকর্তা বলেছেন।
বিশ্বজুড়ে আন্তঃসীমান্ত বাণিজ্যের অধিকাংশই ডলারে হয়ে থাকে এবং তা মার্কিন ব্যাংকিং ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রবাহিত হয়। আর এই কারণে রাশিয়া, ইরান এবং তালেবান-নেতৃত্বাধীন আফগানিস্তানের মতো প্রতিদ্বন্দ্বী বিভিন্ন দেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ এবং তাদের সম্পদ জব্দ করার অনন্য ক্ষমতা অনুশীলন করে থাকে যুক্তরাষ্ট্র।
তবে নিষেধাজ্ঞার সমালোচকরা মার্কিন ডলারকে ‘অস্ত্রীকরণ’ করার এবং এর বৈশ্বিক মর্যাদাকে ক্ষুণ্ন করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে অভিযুক্ত করেছেন।
সম্প্রতি বেশ কিছু দেশ ডলার ব্যবহার করার প্রয়োজনীয়তা এড়াতে চীনা মুদ্রা ইউয়ানে পেমেন্ট বেছে নেবে বলে ইঙ্গিত দেওয়ার পর বাংলাদেশের এই সিদ্ধান্ত সামনে এলো। এর আগে গত মার্চ মাসে চীনের সাথে বাণিজ্যের জন্য ডলার পরিত্যাগের ঘোষণা দেয় ব্রাজিল। এই ঘটনাকে চীনা কর্মকর্তারা এবং দেশটির রাষ্ট্রীয় মিডিয়া আমেরিকান আধিপত্যের পতনের একটি পদক্ষেপ হিসাবে উদযাপন করে।
চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংও সৌদি আরবসহ পারস্য উপসাগরীয় দেশগুলোকে তেলের জন্য ইউয়ান গ্রহণ করার চাপ দিচ্ছেন। সারা বিশ্বের জন্য অত্যাবশ্যকীয় এই পণ্যটির দাম কয়েক দশক ধরে প্রায় একচেটিয়াভাবে ডলারে রাখা হয়েছে। তবে এখন তেল বাণিজ্যের ছোট একটি অংশ ইউয়ানে চালান করা হয়।
ওয়াশিংটন পোস্ট বলছে, চীনা মুদ্রা ইউয়ানে পারমাণবিক কেন্দ্রের জন্য অর্থ পরিশোধ রাশিয়া ও বাংলাদেশের মধ্যে যথারীতি বাণিজ্য পুনরায় শুরু করার পথ প্রশস্ত করতে পারে। কারণ ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের পর থেকে নিষেধাজ্ঞার কারণে ঢাকা-মস্কোর মধ্যে আগের তুলনায় বাণিজ্য এখন অনেকটাই পঙ্গু হয়ে গেছে।