বিশ্ব মন্দায় অব্যবহৃত থাকছে আইপিও’র অর্থ
শাহ আলম নুর : বিশ্ব মন্দার কারনে অব্যবহৃত থাকছে ইনিশিয়াল পাবলিক অফারিং (আইপিও) এর অর্থ। ব্যবসা সম্প্রসারনের লক্ষ্যে অর্থ সংগ্রহ করা হলেও এখন পর্যন্ত অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান এ অর্থ ব্যবহার করতে পারছে না। বিশ্ব মন্দার কারনে মুলধনি যন্ত্রপপাতি আমদানি না করতে পারার কারনে এমন হচ্ছে বলে তারা জানিয়েছে।
তথ্যে দেখা যায় অনেক কোম্পানির ভবন নির্মাণের কথা থাকলেও বিশ^ মন্দার কারনে এগিয়েছে ধীর গতিতে। অনেকে আবার ব্যবসায়িক পরিকল্পনা পরিবর্তন বিশ^ মন্দার কবলে পড়েছে। কেউ কেউ টাকা ব্যবহার করতে না পেরে এফডিআর করে রেখেছেন। সব মিলিয়ে আইপিও’র অর্থ ব্যবহার করতে পারছে না অধিকাংশ কোম্পানি।
বিশ^ মন্দার কারনে পুঁজিবাজারে নতুন তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর আইপিও (ইনিশিয়াল পাবলিক অফারিংস) প্রকল্প বাস্তবায়নে চরম নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। মহামারির কারণে কোম্পানিগুলো ব্যবসায়িকভাবে মার খাচ্ছে, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে এসব প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন করতে পারছে না। এতে প্রকল্প ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে বাস্তবায়ন কাজ পিছিয়ে যাওয়ায় ওই সব প্রকল্পগুলো থেকে রিটার্ন পাওয়ার বিষয়টিও পিছাচ্ছে। বিনিয়োগকারীরা এসব প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
পর্যালোচনায় দেখা যায় কোম্পানিগুলোর মধ্যে অনেকে কোভিডের কারণে নতুন প্রকল্পের মেশিনারি আমদানি করতে পারেনি। আবার অনেকে মেশিনারি আমদানি করলেও মহামারির কারণে স্থাপন করতে পারতে পারেনি। এসব প্রতিষ্ঠান মহামারী ধাক্কা থেকে পুনরুদ্ধার করতে শুরু করেছিল। এমন সময় রাশিয়া-ইউক্রেন ঘটনা ঘটেছিল এবং ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে।
তথ্যে দেখা যায় গত পাঁচ থেকে ছয় বছরে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলো তাদের প্রাথমিক পাবলিক অফার (আইপিও) প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যাপক মন্দার সম্মুখীন হচ্ছে। কোভিড-১৯ এর শুরুতে একের পর বিশ^ মন্দা সহ বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার কারণে এমন হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ঠরা মনে করছেন।
বিশ^ মন্দার করনে আইপিও সংগ্রহ করা প্রতিষ্ঠানগুলোতে যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য ক্রেডিট লেটার (এলসি) খোলায় মন্থর প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। মুলধনি যন্ত্রপানি বিভিন্ন উন্নয়ন কাজ বাস্তবায়নে আইপিও’র অর্থ ব্যয়ের একটি প্রধান অংশ ছিল। সঠিক ভাবে আইপিও অর্থ ব্যয় না করতে পারার কারনে এসব প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করে প্রত্যাশিত মুনাফা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা।
কোম্পানিগুলো দাবি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির জন্য এলসি খোলার অনুমোদন দিচ্ছে। তবে মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানিতে বেশ সমস্যায় পড়তে হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, জুলাই ২০২২ থেকে ফেব্রুয়ারি ২০২৩ পর্যন্ত, মোট এলসি খোলার পরিমাণ ২৩.৪৫% কমে ৪৫.৫১ বিলিয়ন হয়েছে, যা এক বছর আগের একই সময়ে ৫৯.৪৫ বিলিয়ন ছিল। এবং উল্লেখিত সময়ের মধ্যে মূলধন যন্ত্রপাতির জন্য এলসি খোলার পরিমাণ ৫৪.১১% কমে ২.১৪ বিলিয়ন হয়েছে, যা এক বছর আগে ৪.৬৬ বিলিয়ন ছিল।
বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, নতুন তালিকাভুক্ত বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানই ডলার সংকট ও এলসি খোলার কারণে যন্ত্রপাতি আমদানি করতে পারছে না। এসব প্রতিষ্ঠান সময় বাড়ানোর জন্য বিএসইসির কাছে আবেদন করেছে। এসব আবেদনকারির মধ্য থেকে অনেক প্রতিষ্ঠানকে ইতিমধ্যে তাদের আইপিও তহবিল ব্যবহার করার জন্য আরও সময় দেওয়া হয়েছে।
কাট্টালি টেক্সটাইল ২০১৮ সালে আইপিওর মাধ্যমে ৩৪ কোটি টাকা সংগ্রহ করেছে। ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য যন্ত্রপাতি ক্রয়ের জন্য তহবিল থেকে ৯ কোটি টাকা বরাদ্দও দেয়া হয়েছে। কোভিড-১৯ মহামারী, ডলার সংকটসহ বেশ কিছু কারনে এলসি খোলার পর যন্ত্রপাতির জন্য বরাদ্দকৃত তহবিলের ৭৭% অব্যবহৃত রয়ে গেছে।
লুবরিভ বাংলাদেশ লি: একটি লুব্রিকেন্ট রি-রিফাইনার এবং ব্লেন্ডার প্রতিষ্ঠান। ২০২১ সালে আইপিওর মাধ্যমে ১৫০ কোটি টাকা সংগ্রহ করেছে। কোম্পানিটি ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য ৯৮ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি ক্রয় করতে চেয়েছিল। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য তহবিলের মাত্র ৪৬.১% ব্যবহার করতে পেরেছে। এতে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তাদের আইপিও প্রকল্প শেষ করতে পারেনি।
কোম্পানির চিফ ফাইন্যান্সিয়াল অফিসার (সিএফও) মফিজুর রহমান বলেন, “ডলার সংকটের কারণে আমরা সঠিকভাবে কাঁচামাল আমদানি করতে পারিনি। এখন বড় অঙ্কের পরিবর্তে ছোট এলসির অনুমতি পাচ্ছি।”
তিনি বলেন “কোম্পানিটি তার আইপিও প্রকল্পটি সম্পূর্ণ করার জন্য সময় বাড়ানোর জন্য কমিশনের কাছে আবেদন করেছে”।
ডোমিনেজ স্টিল বিল্ডিং সিস্টেমস লিমিটেড, স্টিল বিল্ডিং স্ট্রাকচার বা প্রিফেব্রিকেটেড স্টিল স্ট্রাকচার ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান। আইপিওর মাধ্যমে ২০২০ সালে ৩০ কোটি টাকা সংগ্রহ করে।
ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য প্রতিষ্ঠানটি ৫.৮৬ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি আমদানি করতে চেয়েছিল। কিন্তু কোম্পানিটি এখন পর্যন্ত কোনো আমদানি করতে পারেনি।
ডমিনেজ স্টিলের কোম্পানি সেক্রেটারি মোঃ জামির হোসেন চৌধুরী বলেন, ব্যাংকগুলো এখন নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য ও ওষুধের কাঁচামাল আমদানির জন্য এলসি খোলার সুযোগ দিচ্ছে।
তিনি আরো বলেন, ব্যাংকগুলো বলছে বাংলাদেশ ব্যাংক যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য এলসি নিষিদ্ধ করেছে। এখন আমরা আমাদের আইপিও প্রকল্পের যন্ত্রপাতি আমদানি ছাড়া অন্য অংশের কাজ করছি।
তিনি বলেন সকল প্রকার নির্মাণসামগ্রীর দাম আকাশছোঁয়া হওয়ায় আমরা কার্যাদেশ অনুযায়ী কাজ শেষ করতে পারছি না। এখন যদি আমরা দামি কাঁচামাল ব্যবহার করে প্রকল্পটি শেষ করি, তাহলে লোকসানের প্রকল্প হতে পারে।
তিনি বলেন “এছাড়া, আমাদের আইপিও তহবিল ব্যবহার করার জন্য আমাদের ১৫ মাসেরও বেশি সময় আছে।
দেশের অন্যতম বড় নির্মাণ ও প্রকৌশল কোম্পানি মীর আক্তার ২০২০ সালে ১২৫ কোটি টাকা সংগ্রহ করেছে। কিন্তু একই সমস্যার কারণে প্রতিষ্ঠানটি যন্ত্রপাতির বড় অংশ আমদানি করতে পারেনি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রতিষ্ঠানটির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, “আমরা এ বিষয়ে কমিশনের কাছে সময় বাড়ানোর আবেদন করেছি। কমিশন আইপিও তহবিল ব্যবহারের জন্য অতিরিক্ত আট মাসের জন্য অনুমোদন দিয়েছে।”
এ্যাকমি পেস্সিাইজ লি: আইপিওর মাধ্যমে ২০২১ সালে ৩০ কোটি টাকা সংগ্রহ করেছে । কোাম্পানিটি ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য ১০.৫০ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি কিনতে চেয়েছিল। কিন্তু গত দুই বছরে তা করতে ব্যর্থ হয়েছে।
প্রতিষ্ঠানটির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেছেন, শুধু যন্ত্রপাতি আমদানির জন্যই ছেড়ে দিন। ব্যাংকগুলি কাঁচামালের জন্যও সঠিকভাবে এলসি ইস্যু করতে পারছে না। তিনি আরো বলেন, এই এলসি ইস্যুর কারণে আমরা স্থানীয়ভাবে যন্ত্রপাতি সংগ্রহের চেষ্টা করছি।
একই ক্রনে ২০২০ সালে তালিকাভুক্ত অ্যাসোসিয়েটেড অক্সিজেন তার আইপিওর অর্থে শুধুমাত্র ২০% যন্ত্রপাতি আমদানি করতে পারেছে।