তিন হাজার কোটি টাকার সভরেন গ্যারান্টি পাচ্ছে রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান আইসিবি
শেয়ারবাজার ডেস্ক: রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশকে (আইসিবি) তিন হাজার কোটি টাকার সভরেন গ্যারান্টি দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। গতকাল বৃহস্পতিবার অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে এ সংক্রান্ত একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সরকার আইসিবিকে এ সভরেন গ্যারান্টি দেবে। তবে এ তিন হাজার কোটি টাকার সভরেন গ্যারান্টি আইসিবি পেতে সময় লাগবে প্রায় এক মাস।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, ‘আজকে (বৃহস্পতিবার) আমাদের একটি বৈঠক ছিল যেখানে পুঁজিবাজারকে শক্তিশালী করার জন্য আইসিবি একটি তহবিল পেতে বলেছিল সে বিষয়ে একটি বৈঠক হয়েছে। বৈঠকে আজকের (বৃহস্পতিবার) মধ্যেই আমরা চেষ্টা করি সেটাকে রেজুলেশন আকারে করে অর্থ উপদেষ্টার কাছে তুলে ধরার জন্য।’
তিনি বলেন, ‘পরবর্তীতে অর্থ উপদেষ্টা এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়কে সভরেন গ্যারান্টি দেয়ার জন্য নির্দেশনা দেবেন। পরবর্তীতে এ গ্যারান্টি পেলে বাংলাদেশ ব্যাংক বা অন্য কোনো ঋণদাতা ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে সমপরিমাণ টাকার ঋণ নিতে পারবে আইসিবি।’
তথ্য অনুযায়ী, আইসিবিকে ৩ হাজার কোটি টাকার সভরেন গ্যারান্টি দেয়ার আলোচনা কয়েকমাস আগে থেকে ছিল। পরবর্তীতে তা আলোচনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। গত ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সেই আলোচনার ইতি ঘটে। অনিশ্চিত হয়ে যায় আইসিবির ঋণ পাওয়া। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর সম্প্রতি আইসিবিকে ৩ হাজার কোটি টাকার সভরেন গ্যারান্টি দেয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। ফলে এক মাস বা তার কিছুটা বেশি সময়ের মধ্যে ৩ হাজার কোটি টাকার সভরেন গ্যারান্টি পেতে যাচ্ছে আইসিবি। এ গ্যারান্টি পেলে বাংলাদেশ ব্যাংক বা অন্য কোনো ঋণদাতা ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে সমপরিমাণ টাকার ঋণ নিতে পারবে আইসিবি।
জানা যায়, গত কয়েক বছর ধরে কয়েক দফায় শেয়ারবাজারে বিনিয়োগে তারল্য সংকট মেটাতে সরকারের কাছে ৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ চেয়ে আসছিল আইসিবি। তবে আর্থিক সংকটে থাকা সরকারের পক্ষে সরাসরি ঋণ দেওয়া সম্ভব হয়নি। এরপর গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতা ছেড়ে পালিয়ে গেলে সেই গ্যারান্টার হওয়ার স্বপ্নও ধুলিসাৎ হয় আইসিবির। তবে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর নতুন করে এ বিষয়টি সামনে এনে তা সমাধানে ৩ হাজার কোটি টাকার সভরেন গ্যারান্টার হওয়ার জন্য সম্মত হয়েছে। এতে পুঁজিবাজারে বড় বিনিয়োগ করতে আইসিবির সক্ষমতা আরও বৃদ্ধি পাবে।
এফআইডির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, আইসিবির ঋণ আবেদনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে। সরকার আইসিবিকে সরাসরি ঋণ দিতে পারবে না। তবে গ্যারান্টি দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত আছে।
এ ব্যাপারে জানতে আইসিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবু আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তা সম্ভব হয়নি।
তবে আইসিবির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ‘পুঁজিবাজারের জন্য সরকারের কাছ থেকে তহবিল সহায়তা পাওয়ার ব্যাপারে আমরা খুবই ইতিবাচক ও আশাবাদী। আমরা প্রয়োজনীয় বিষয়াদির ব্যাপারে কাজ করছি।
তিনি বলেন, ‘যেহেতু আইসিবির প্রধান উদ্দেশ্যই হচ্ছে পুঁজিবাজারকে সমর্থন দেওয়া, তাই তহবিলের একটি অংশ পুঁজিবাজারে সরবরাহ করা হবে। এছাড়া পুঁজিবাজারকে সহায়তা দিতে কয়েক বছর ধরে আইসিবি’র নেওয়া উচ্চ-সুদের মেয়াদি আমানত পরিশোধ করতেও তহবিলের কিছু অংশ ব্যবহার করা হবে।’
মুনাফা কমছে আইসিবির
২০২২ সালের জুলাই মাসে ফ্লোর প্রাইস ব্যবস্থা চালুর প্রায় দুই বছর পর জানুয়ারিতে তা অপসারণের পরে বাজার মূলধন প্রায় এক লাখ কোটি টাকা কমে যায়। ফ্লোর প্রাইস হলো কোনো স্টক বেচাকেনার সর্বনিম্ন মূল্য। আর শেয়ার নির্ধারিত ফ্লোর প্রাইসের নিচে নামতে পারে না। বাজারের অস্থিরতা রোধের পদক্ষেপের অংশ হিসেবে বিএসইসি গত ২৪ এপ্রিল তালিকাভুক্ত কোনো কোম্পানির শেয়ারের দাম দিনে ৩ শতাংশের বেশি কমতে পারবে না বলে আদেশ দেয়।
অস্থিতিশীল বাজারের কারণে ২০২৩–২৪ অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে আইসিবি ২৬৭ কোটি টাকা লোকসান করেছে। এটির মূলধন লাভ ৫৯ শতাংশ কমে ১০৫ কোটি টাকা হয়েছে। এছাড়া আমানত ও ঋণের সুদ পরিশোধ ৯ দশমিক ৬১ শতাংশ বেড়ে ৬৭৫ কোটি টাকা হয়েছে।
২০২২–২৩ অর্থবছরে বিনিয়োগ ব্যাংকটির মুনাফা ৪৬ শতাংশ হ্রাস পেয়ে ৭৭ কোটি টাকা হয়। এছাড়া ফ্লোর প্রাইস সীমাবদ্ধতার মধ্যে শেয়ার বিক্রি করতে না পারায় আইসিবি এটির আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দিতে ব্যর্থ হয়েছে।
মেয়াদি আমানত বোঝা
২০২২–২৩ অর্থবছরের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুসারে, সাধারণ জনগণ, ব্যাংক, নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠান থেকে আইসিবির আট হাজার ৮৭৭ কোটি টাকা মেয়াদি আমানত রয়েছে। সুদের হারে সাম্প্রতিক উল্লম্ফন প্রতিষ্ঠানটির ওপর ঋণ পরিশোধের চাপ বাড়িয়ে দিয়েছে।
আইসিবিতে ব্যাংক ও নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মেয়াদি আমানত ৫ হাজার ৩২২ কোটি টাকা এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মেয়াদি আমানত ৩ হাজার ৫৪৬ কোটি টাকা।
সোনালী ব্যাংক, সাধারণ বীমা কর্পোরেশন, অগ্রণী ব্যাংক এবং জনতা ব্যাংকের আইসিবিতে মেয়াদি আমানত রয়েছে তিন হাজার ৫৬৩ কোটি টাকা। বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, মেয়াদি আমানতের জন্য বিনিয়োগ ব্যাংকটি সুদ পরিশোধ করেছে ৬৬৩ কোটি টাকা।
আটকে আছে আইসিবির তহবিল
সংস্থাটির কর্মকর্তাদের মতে, আইসিবির প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ রয়েছে। এর বেশিরভাগই দুর্বল ব্যাংক এবং নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে। কেবল পদ্মা ব্যাংকেই আটকে রয়েছে সংস্থাটির ১৫৪ কোটি টাকা।
আমানতের মেয়াদ পূর্ণ হলেও আইসিবি এসব তহবিল ফেরত পায়নি। অর্থ পেতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাহায্য চেয়েছিল এটি। কিন্তু নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো আমানত ফেরত দিতে পারেনি। ফলে বেশিরভাগ তহবিলের মেয়াদ নবায়ন করতে হয়েছে।