আর্থিক খাতে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার নিয়ে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে সংলাপ অনুষ্ঠিত
নিজস্ব প্রতিবেদক: বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) কমিশনার ফারজানা লালারুখ বলেছেন, বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন স্টেক হোল্ডারদের সঙ্গে আমরা যখন মিটিং করি, তাদের কাছে প্রথম যে বড় সমস্যাটার কথা শুনি তা হলো বিনিয়োগকারীদের আস্থাহীনতা।
তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত তাদের সাথে করা প্রায় ৩২ টি মিটিংয়ে আমরা শুনেছি পুঁজিবাজারের ধারাবাহিকতা না থাকার জন্য আস্থাহীনতা, ফলে ইনভেস্টররা বাজারে আসতে চাইছেন না। এই মুহুর্তে সব থেকে বড় যে সমস্যাটি আমরা ফেইস করছি তা হলো আস্থা ফিরিয়ে নিয়ে আসা।
শনিবার (১৬ নভেম্বর) দুপুরে রাজধানীর বাড্ডায় ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির ব্র্যাক বিজনেস স্কুলের আয়োজনে অনুষ্ঠিত ‘পলিসি ডায়ালগ অন ফিন্যানসিয়াল অ্যান্ড ইকোনমিক রিফর্মস ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক সেমিনারে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
ফারজানা লালারুখ বলেন, একজন একাডেমিশিয়ার হিসেবে আমরা যেগুলো পড়িয়েছি যেমন সার্কুলার ট্রেডিং অথবা মার্কেট ম্যানুপুলেশন এগুলা যদি আমাদের বাজার দিয়ে আপনাদের সামনে তুলে ধরতে পারতাম তাহলে আপনাদের দেখাতে পারতাম বাজারে যারা কারসাজি করছে তারা আমাদের চেয়ে অনেক বেশি এগিয়ে আছে। আর তাদের থেকে আমাদের সার্ভিল্যান্স আমাদের ইন্টিলিজ্যান্স অনেক পিছিয়ে।
বিএসইসির এই কমিশনার বলেন, আমরা অনেক ক্ষেত্রে এসব দুষ্টু লোকদের জরিমানা করছি, কিন্তু প্রশ্ন হলো এই কাজগুলো যেসময় করা দরকার সেসমইয় করার জন্য আমরা প্রস্তুত কিনা। পুঁজিবাজারের এই সংকট মোকাবেলায় আমাদের প্রধান কাজ হবে বাজারে আস্থা ফিরিয়ে আনা। আমরা সচ্ছতা, কাউন্টেবলিটি এবং ডিজিটালাইজেশনের মাধ্যমে এই আস্থা ফিরিয়ে আনতে চাই।
এই সংলাপ অনুষ্ঠানে ‘অ্যাকশেনেবল ফাইনান্সিয়াল অ্যান্ড ইকোনমিক পলিসিস ফর অ্যান ইনক্লুসিভ, ইকুইটেবল অ্যান্ড প্রোসপেরাস বাংলাদেশ শীর্ষক উদ্বোধনী প্লেনারি সেশনে প্রধান বক্তা এবং প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অর্থ এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে আরও উপস্থিত ছিলেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য ও ব্র্যাক ব্যাংকের চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার অ্যান্ড ম্যানেজিং ডিরেক্টর সেলিম আর এফ হোসেন।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে রাজস্ব খাতে পলিসি আর ইমপ্লিমেন্টশন আলাদা করা হবে বলে জানান অর্থ উপদেষ্টা। তিনি বলেন, বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানই ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। অনেক প্রকল্প করা হয়েছে, ফিজিবিলিটি টেস্ট করা হয়নি। সংস্কারের ক্ষেত্রে মাল্টিলেটারাল, বাইলেটারাল সবাই সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে। অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা না থাকলে, বিদেশি সহযোগীরাও সহায়তা কমিয়ে দেবে বলেও জানান সালেহউদ্দিন আহমেদ।
সাধারণ মানুষকে আশ্বস্ত করে উপদেষ্টা বলেন, অর্থনৈতিক খাতে যেভাবে লুটপাট হয়েছে, তা থেকে বেরিয়ে আসতে কাজ করা হচ্ছে। অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য ইতোমধ্যে বিশ্ব ব্যাংক, আইএমএফসহ বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে বৈঠক করেছি। তারা আমাদের ঋণ দিতে বেশ আগ্রহী। আশা করছি এ অবস্থা দূরতই উন্নতি হবে।
এই সংলাপে দেশের আর্থিক খাতে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার নিয়ে প্যানেল আলোচনা, পোস্টার প্রেজেন্টেশন এবং আর্থিক খাতের চলমান চ্যালেঞ্জসমূহ মোকাবেলার জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার বিষয়ে আলোচনা করা হয়। দিনব্যাপী এই সংলাপ অনুষ্ঠানে বিভিন্ন আলোচনায় আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিভিন্ন সেক্টরের নীতি নির্ধারক, ইন্ডাস্ট্রি প্রফেশনালস, শিক্ষাবিদসহ আমন্ত্রিত অতিথিগণ।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, মাসোহারা দিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভেতরে লোক রাখা হয়েছিল। তারা টাকা ছাপিয়েছে, ভুয়া রিজার্ভ দেখিয়েছে। ব্যাংক চালানোর মতো যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও এমন ব্যক্তিকে ব্যাংকের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
দেবপ্রিয় বলেন, আমরা মধ্যম আয়ের ফাঁদে পড়ে আছি। রাষ্ট্রের মেরামত যদি না হয়, দুই পয়সার সংস্কার করে কোনও লাভ হবে না। অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা আনা না গেলে, সংস্কারের পথে এগোনো সম্ভব নয়। অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা আনার পর, যদি দ্রুত সংস্কার না করা যায় তাহলেও এগোনো সম্ভাবনা হবে না বলেও মন্তব্য করেন সিপিডির এই সম্মানীয় ফেলো।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের দুটো কিডনি। একটি ফিন্যানসিয়াল সেক্টর, আরেকটি এনার্জি সেক্টর। দুটোই খেয়ে ফেলেছে বিগত সরকার। যারা এনার্জি সেক্টর খেয়েছে, তারাই আবার ফিন্যানসিয়াল সেক্টর খেয়েছে।
অনুষ্ঠানের প্লেনারি সেশন, প্যানেল আলোচনা এবং পোস্টার প্রেজেন্টেশনের মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনীতির বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এর সংস্কারের রূপরেখা তুলে ধরেন আলোচকবৃন্দ। প্যানেল আলোচনায় আলোচকদের মধ্যে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক বাংলাদেশ এর সিইও নাসের এজাজ বিজয়, লঙ্কাবাংলা ফাইন্যান্স এর ম্যানেজিং ডিরেক্টর হুমায়রা আজম, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির প্রফেসর এবং সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা মোঃ আজিজুল ইসলাম, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান, মোঃ আবদুর রহমান খান, সানেম এর এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর ড. সেলিম রায়হান, ইউএসএআইড এর ইকোনোমিক গ্রোথ অ্যান্ড গর্ভন্যান্স এর ডিরেক্টর মিখাইল টুরাডসহ বিভিন্ন সেক্টরের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ আলোচনায় অংশ নেন।
তিনটি উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে এই সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রথমটি হলো-দেশের আর্থিক খাতের বর্তমান নীতি ও কার্যপ্রণালীর দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করা। দ্বিতীয়টি হচ্ছে- আর্থিক খাতের উন্নয়নের জন্য সংস্কারের প্রস্তাব দেওয়া এবং তৃতীয়টি হলো- আর্থিক খাতের সংস্কার বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় সুপারিশ প্রদান।
আয়োজকেরা মনে করেন, এই প্রস্তাবনাগুলো একটি কার্যকর ও স্বচ্ছ আর্থিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সাহায্য করবে, যা সমগ্র অর্থনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে এবং ব্যক্তিগত, প্রাতিষ্ঠানিক ও জাতীয় স্তরে সকলের কল্যাণে অবদান রাখবে।