ই-ল্যাপ: বাংলাদেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের ঋণপ্রাপ্তির প্রক্রিয়া সহজ করে দিয়েছে যে প্ল্যাটফর্ম
নিজস্ব প্রতিবেদক: বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণপ্রাপ্তির প্রক্রিয়া গ্রাহকদের জন্য অনেক সময় নানাবিধ কাগজপত্রের জটিল গোলকধাঁধার মতো মনে হতে পারে। ব্যবসায়ের মালিক এবং উদ্যোক্তাদের জন্য এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। কারণ, এখানে কাগজপত্র জমা, রিলেশনশিপ অফিসারদের বারবার স্বাক্ষর নিতে আসা এবং অন্যান্য অনেক প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত সময় লেগে যায়।
এই সমস্যার একটি স্মার্ট সমাধানের কথা ভাবল ব্র্যাক ব্যাংক।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে ২০২২ সালে ব্র্যাক ব্যাংক চালু করে ইলেকট্রনিক লোন অ্যাপ্লিকেশন প্রপোজাল (eLAP) বা ই-ল্যাপ। লোন প্রক্রিয়াকে দ্রুত এবং অধিক কার্যকর করে তোলার একটি ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম এটি। ২০২৩ সালের ডিসেম্বর নাগাদ দেশব্যাপী ৫৫৬টি এসএমই ইউনিট অফিসে এটি চালু করা হলে বাংলাদেশের এসএমই ব্যাংকিং ব্যবস্থায় লক্ষণীয় পরিবর্তন দেখা যায়।
এর ফলে, সত্যিকার অর্থেই ব্যাংকিং খাতে লোন ম্যানেজমেন্টে আমূল পরিবর্তন এসেছে।
ই-ল্যাপ চালু হওয়ার আগে ঋণপ্রাপ্তির প্রক্রিয়া ছিল অনেকগুলো ধাপে বিভক্ত। ঋণ আবেদন গ্রহণ থেকে শুরু করে ঋণ অনুমোদন পর্যন্ত প্রতিটি ধাপেই ম্যানুয়াল ডেটা এন্ট্রি ও ডকুমেন্ট হ্যান্ডলিংয়ের প্রয়োজন হতো, যেটি ছিল অত্যন্ত সময়সাপেক্ষ এবং এখানে ভুল হওয়ার প্রবণতাও ছিল অনেক বেশি। সেই বিষয়টি মাথায় রেখেই ব্র্যাক ব্যাংক চালু করে ই-ল্যাপ। ভিফিন সল্যুশনস লিমিটেডের তৈরি এই প্ল্যাটফর্মটি ব্যবহার করা খুবই সহজ। লোকাল রেগুলেশন সম্পূর্ণরূপে মেনে চলার পাশাপাশি ই-ল্যাপ বিভিন্ন স্তরের প্রযুক্তিগত দক্ষতাসম্পন্ন ব্যবহারকারীদের জন্য উপযোগী একটি প্ল্যাটফর্ম।
ই-ল্যাপের কারণে ব্র্যাক ব্যাংকের কার্যক্রমে গতি ও দক্ষতা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
লোন প্রসেসিং টাইম কমানোই ছিল মূল লক্ষ্য: ডকুমেন্ট হ্যান্ডলিং এবং বিভিন্ন স্তরের অনুমোদনের কারণে আগে এসএমই লোনের আবেদন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে গড়ে ১৫ কর্মদিবসের প্রয়োজন হতো। তবে, ই-ল্যাপ চালু হওয়ার ফলে এই সময় কমে দাঁড়িয়েছে ১৩ দিনে। কারণ, এখন আগের চেয়ে দ্রুততর সময়ে যাচাই-বাছাই ও অন্যান্য কার্যক্রম সম্পন্ন হয়।
ডকুমেন্ট হ্যান্ডলিং আগের চেয়ে আরও সহজ হয়েছে। এখন লোন অ্যাপ্লিকেশন জমা দেওয়া যায় ডিজিটাল পদ্ধতিতে। ফলে, শুধুমাত্র চূড়ান্ত ধাপে আবেদনকারীকে স্বাক্ষরের জন্য উপস্থিত হতে হয়। এটি কাগজপত্রের ঝামেলা কমিয়েছে এবং রিলেশনশিপ অফিসারদেরও বারবার ভিজিটের প্রয়োজন হয় না।
রিয়েল-টাইম ট্র্যাকিংয়ের মাধ্যমে পুরো প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ই-ল্যাপ সিস্টেমের মাধ্যমে ব্যাংক কর্মকর্তারা প্রতিটি ঋণ আবেদনের বর্তমান অবস্থা, দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার নাম এবং আবেদন কোন পর্যায়ে রয়েছে, তা রিয়েল-টাইমে পর্যবেক্ষণ করতে পারেন। এটি জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি পুরো প্রক্রিয়ায় গতিশীলতাও বাড়িয়েছে।
পুনঃআবেদনের ক্ষেত্রে সময় সাশ্রয় হয়েছে ব্যাপক: পূর্বে করা আবেদনের তথ্য স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংগ্রহ করতে পারে ই-ল্যাপের সিস্টেম ইনকোয়্যারি ফিচার। ফলে, ম্যানুয়াল এন্ট্রির প্রয়োজন হয় না। এটি বাহুল্যতা হ্রাসের পাশাপাশি প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হওয়ার সময় এবং ভুলের পরিমাণ কমিয়েছে।
সেইসাথে ব্যাংক কর্মকর্তাদের কাজের গতি বাড়িয়ে তাঁদের কর্মপদ্ধতি আরো সহজ এবং দক্ষ করে তুলেছে। মোবাইল ডিভাইস থেকেও ই-ল্যাপে লগইন করা যায়। ফলে, রিলেশনশিপ অফিসার ও বিজনেস ডেভেলপমেন্ট ম্যানেজাররা যেকোনো স্থান থেকে গ্রাহকদের সেবা দিতে পারেন। ব্র্যাক ব্যাংক ইতিমধ্যে ২,২৩৭ জন ফিল্ড কর্মকর্তাকে ইলেকট্রনিক ট্যাবলেট দিয়েছে, যাতে তাঁরা যেকোনো স্থান থেকে গ্রাহকদের উন্নত মানের সেবা দিতে পারেন।
ব্যয় হ্রাসেও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এসেছে, বিশেষ করে বাতিল আবেদনপত্রের ক্ষেত্রে। যেসব আবেদন বাতিল হতো, আগে সেগুলোও প্রিন্ট করা হতো। এখন কেবল অনুমোদিত আবেদনপত্রই প্রিন্ট করা হয়, যা অপচয় এবং অপ্রয়োজনীয় প্রিন্টিংয়ের খরচ অনেকাংশেই কমিয়ে দিয়েছে। ই-ল্যাপের স্বয়ংক্রিয় প্রক্রিয়াগুলো ডেটা এন্ট্রির ভুল কমিয়ে এনেছে। ফলে, ক্রেডিট ও অপারেশনস টিম আরও নির্ভুলভাবে ডকুমেন্ট হ্যান্ডলিংয়ের কাজ করতে পারছে।
ই-ল্যাপের প্রভাব বহুমুখী এবং সুদূরপ্রসারী। এটি ৫৫৬টি এসএমই ইউনিট অফিস ও লোন প্রক্রিয়ায় যুক্ত ৩,৭০০-এরও অধিক ব্র্যাক ব্যাংক কর্মীকে সহায়তা করছে।
ই-ল্যাপ শুধু সময়ই নয়, এটি উল্লেখযোগ্যভাবে ব্যয়ও হ্রাস করেছে। মোট টার্নঅ্যারাউন্ড টাইম (টিএটি) দুই দিন এবং কাস্টমার সার্ভিস টাইম ছয় দিন হ্রাস পাওয়ার পাশাপাশি প্রত্যেক কর্মীর বছরে কমপক্ষে ১০ দিন সময় সাশ্রয় হয়েছে। ২০২৪ সালের প্রথম ছয় মাসে ই-ল্যাপ অনবোর্ডিং খরচে ৫.৮৫ কোটি টাকা এবং কুরিয়ার খরচ ২৫% হ্রাস করতে সক্ষম হয়েছে।
ই-ল্যাপ গ্রাহকদের এক ব্যতিক্রমী ব্যাংকিং অভিজ্ঞতা দিচ্ছে।
আগে সপ্তাহজুড়ে অপেক্ষা করতে হতো এবং বারবার ব্যাংকে যেতে হতো। তবে, এখন এই প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে ঋণ আবেদন খুব দ্রুত সম্পন্ন হচ্ছে। সিস্টেম থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে স্যাংশন লেটার তৈরি হওয়ায় পুরো প্রক্রিয়াটি আরও স্বচ্ছ হয়েছে, যা ভুল বোঝাবুঝি ও অভিযোগ হ্রাস করেছে। ই-ল্যাপের কোয়্যারি ম্যানেজমেন্ট ফিচার গ্রাহকদের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার প্রক্রিয়া আরও সহজ করে দিয়েছে। ফলে, একের সাথে অন্যের বারবার যোগাযোগ করার প্রয়োজন হচ্ছে না। এটি গ্রাহক ও ব্যাংক কর্মীদের জন্য প্রক্রিয়াটি আরও সহজ করে দিয়েছে।
কোর ব্যাংকিং সিস্টেমের সাথে সংযোগ স্থাপনের ফলে ই-ল্যাপের কার্যকারিতা আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। ব্র্যাক ব্যাংক ২০২৪ সালের জুলাই মাসে ই-ল্যাপকে কোর ব্যাংকিং সিস্টেমের সাথে যুক্ত করেছে, যা ইএমআই ক্যালকুলেশন এবং ফান্ড ডিজবার্সমেন্টের মতো কাজগুলোর প্রসেসিং রিয়েল-টাইমে নিয়ে এসেছে। এই সংযোগ স্থাপনের ফলে আগে ম্যানুয়াল ক্যালকুলেশনের কারণে যে সময় ব্যয় হতো, তা পুরোপুরি দূর করার মাধ্যমে লোন ডিজবার্সমেন্টকে আরও দ্রুত এবং ঝামেলাহীন করেছে ই-ল্যাপ।
ই-ল্যাপ শুধুমাত্র একটি প্রযুক্তিগত অগ্রগতিই নয়, এটি বাংলাদেশের এসএমই ব্যাংকিং খাতে একটি বড় বিপ্লবও। এই প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে ইতিমধ্যেই ১ লাখের বেশি লোন ডিজবার্স করা হয়েছে, যার মোট পরিমাণ ১৭৮৫২ কোটি টাকা। এটি দেশের ছোট ও মাঝারি ব্যবসায়গুলোকে এগিয়ে নিতে সাহায্য করছে, যা স্থানীয় ও জাতীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে।
স্যার ফজলে হাসান আবেদের স্বপ্ন ছিল বাংলাদেশের ‘মিসিং মিডল’-এর উন্নয়ন। তাঁর ভিশনকে সামনে রেখে ই-ল্যাপকে কাজে লাগিয়ে ব্র্যাক ব্যাংক দেশের আর্থিক সুবিধাবঞ্চিত ও উপেক্ষিত ব্যবসায়গুলোকে আরও বড় পরিসরে সহায়তা করতে পারছে, যা স্থানীয় অর্থনৈনীতিতে ফেলছে ইতিবাচক প্রভাব।
দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বে– যেখানে সময়ই সবচেয়ে মূল্যবান, সেখানে ই-ল্যাপ ব্র্যাক ব্যাংকের উদ্ভাবন ও গ্রাহককেন্দ্রিক সেবার এক অনন্য উদাহরণ। এভাবে ব্র্যাক ব্যাংক গ্রাহক সেবার উন্নয়নে নিজেদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করে চলেছে। বাংলাদেশের এসএমই-গুলোর জন্য এটি শুধুমাত্র একটি প্রযুক্তিগত উন্নয়নই নয়, বরং সম্ভাবনার এক নতুন দুয়ার, যা ঋণপ্রাপ্তি আরও সহজ ও দ্রুততর করার মাধ্যমে জাতীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে অবদান রেখে চলেছে।