ব্যাংকে ফিরছে টাকা, অর্থনীতিতে স্বস্তির ইঙ্গিত

নিজস্ব প্রতিবেদক: দীর্ঘদিন ধরে ব্যাংক খাতে আস্থার সংকট এবং আর্থিক অনিয়মের কারণে সাধারণ মানুষ ও ব্যবসায়ীদের বড় অংশ ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নেওয়ার প্রবণতা দেখিয়েছিল। ফলে ২০২৩ সালের শুরুর দিক থেকে ব্যাংকের বাইরে থাকা নগদ অর্থের পরিমাণ আশঙ্কাজনক হারে বাড়তে থাকে। তবে সাম্প্রতিক তথ্য বলছে, ধীরে হলেও সেই চিত্র বদলাতে শুরু করেছে। টাকা আবার ব্যাংকে ফিরছে, যা অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক লক্ষণ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক তথ্য অনুসারে, টানা দশ মাস ব্যাংকের বাইরে নগদ অর্থের পরিমাণ বাড়লেও গত চার মাসে সেই প্রবণতা উল্টো পথে হাঁটতে শুরু করেছে। বিশেষ করে, ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে ব্যাংকে ফিরেছে ১,০৮৫ কোটি টাকা, যা মানুষের মধ্যে ব্যাংক খাতের প্রতি আস্থা পুনরুদ্ধারের ইঙ্গিত দেয়।
ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকের বাইরে থাকা নগদ অর্থের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২.৭৬ লাখ কোটি টাকা, যা নভেম্বরে ছিল ২.৭৭ লাখ কোটি টাকা। যদিও ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে এটি ছিল ২.৫৫ লাখ কোটি টাকা, অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকা বেড়েছে। তবে আশার কথা হলো, এখন সেই বৃদ্ধি ধীরে ধীরে কমতে শুরু করেছে।
অর্থনীতিবিদদের মতে, ব্যাংকের বাইরে নগদ অর্থের পরিমাণ বাড়লে আর্থিক লেনদেনের গতি কমে যায়, বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হয় এবং সামগ্রিক অর্থনীতি দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে ব্যাংকে টাকা ফেরত আসা সুদূরপ্রসারী ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
যদিও ব্যাংকে টাকা ফিরতে শুরু করেছে, তবে আমানত প্রবৃদ্ধির হার এখনও প্রত্যাশিত মাত্রায় পৌঁছায়নি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে ব্যাংক খাতে আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৭.৭৭ লাখ কোটি টাকা, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৭.৪৪% বেশি।
২০২৩ সালের আগস্টে ব্যাংকে আমানতের প্রবৃদ্ধি ছিল আগের ১৮ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন, মাত্র ৭.০২%। সেপ্টেম্বরে এটি কিছুটা বেড়ে ৭.২৬% হয়, অক্টোবরে ৭.২৮%, নভেম্বরে ৭.৪৬%, তবে ডিসেম্বরে আবার একটু কমে যায়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্যাংকিং খাত থেকে অনিয়মের মাধ্যমে ঋণ গ্রহণ, খেলাপি ঋণের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং দুর্বল ব্যাংকগুলোর অনিশ্চিত অবস্থা আমানতকারীদের আস্থা কমিয়ে দিয়েছিল। ফলে অনেকে টাকা তুলে নিয়ে সঞ্চয়ের বিকল্প পথ খুঁজছিলেন।
২০২৪ সালের আগস্টে আহসান এইচ মনসুর বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছেন।
অন্তত ১১টি ব্যাংকের বোর্ড পুনর্গঠন করা হয়েছে। টাকা ছাপিয়ে তারল্য সহায়তা দেওয়া হয়েছে, যাতে ব্যাংকগুলোর নগদ সংকট দূর হয়। বেনামী ঋণ দেওয়া রোধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। দুর্বল ব্যাংকগুলোর আর্থিক অবস্থার উন্নতির জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক নজরদারি বাড়িয়েছে।
এসব পদক্ষেপের ফলে দুর্বল ব্যাংকগুলোর অবস্থা খুব বেশি ভালো না হলেও অন্তত আরও খারাপের দিকে যাওয়া ঠেকানো গেছে।
বিশেষ করে, ইসলামী ব্যাংক ও ইউসিবি ব্যাংকের অবস্থা উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নত হয়েছে। ফলে ভালো ব্যাংকগুলোর প্রতি আমানতকারীদের আস্থা বাড়তে শুরু করেছে এবং তারা নতুন করে টাকা জমা দিতে শুরু করেছেন।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ব্যাংকে টাকা ফেরার এই ধারা অব্যাহত থাকলে বিনিয়োগের পরিমাণ বাড়বে, যা সামগ্রিকভাবে অর্থনীতিকে চাঙা করতে সাহায্য করবে। তবে ব্যাংক খাতের প্রতি মানুষের পুরোপুরি আস্থা ফিরে আসতে সময় লাগবে।