বাজেটে করের বোঝা অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের চেষ্টাকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে: ফরেন চেম্বার

বাজেটে করের বোঝা অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের চেষ্টাকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে: ফরেন চেম্বার

নিজস্ব প্রতিবেদক: ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে সরকারের ন্যায়সঙ্গত অর্থনৈতিক রূপান্তর ও রাজস্ব ঘাটতি কমানোর প্রতিশ্রুতিকে স্বীকৃতি জানিয়েছে ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ফিকি)। প্রস্তাবিত বাজেটের আকার ধরা হয়েছে ৭,৯০,০০০ কোটি টাকা, যা মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১২.৭ শতাংশ। সরকার ৬.৫% জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছে এবং মূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে, যা গত বছরের তুলনায় ৩২১ বেসিস পয়েন্ট কম। ফিকি বাজেটের সংস্কারমুখী দৃষ্টিভঙ্গিকে ইতিবাচক বলে মনে করলেও কিছু কর ব্যবস্থার বাস্তবায়ন শিল্প ও ব্যক্তির উপর অনিচ্ছাকৃত চাপ সৃষ্টি করতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে।

 

বুধবার ফিকির অফিসে আয়োজিত বাজেট পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে ফিকি সভাপতি জাভেদ আখতার এসব মন্তব্য করেন।

 

ফিকি সৎ ও নিয়মিত করদাতাদের উপর অতিরিক্ত করের চাপ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। চেম্বারটি উল্লেখ করে যে, সংশোধিত কর স্ল্যাব অনুযায়ী যেসব বেতনভুক্ত ব্যক্তি মাসে ৭০,০০০ থেকে ১,০০,০০০ টাকা আয় করেন, তাঁদের উপর করের বোঝা ৫০% থেকে ৬০% পর্যন্ত বাড়তে পারে। একইভাবে, ১,২০,০০০ থেকে ১,৭৫,০০০ টাকা আয়ের ব্যক্তিদের জন্য এই কর বৃদ্ধির হার ২০% থেকে ৩০% পর্যন্ত হতে পারে। এ ধরনের কর বৃদ্ধির ফলে নির্দিষ্ট আয়ভুক্ত জনগোষ্ঠীর ব্যবহারের জন্য উপলব্ধ আয় উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যাবে, যা ভোক্তা ব্যয় ও জীবনমানের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

 

ফিকি আরও উল্লেখ করে যে, কোম্পানির জন্য সর্বনিম্ন করহার ০.৬% থেকে ১% এবং ব্যক্তির জন্য ০.২৫% থেকে ১%-এ বৃদ্ধি করায় ক্ষতিগ্রস্ত হবে লস মেকিং প্রতিষ্ঠান ও মুদ্রাস্ফীতিতে জর্জরিত সাধারণ করদাতারা। উদাহরণস্বরূপ, কোনো কোম্পানি করযোগ্য আয় না করলেও তাকে টার্নওভারের উপর ১% কর প্রদান করতে হবে, যা ইতিমধ্যে সংকটে থাকা প্রতিষ্ঠানের উপর অতিরিক্ত চাপ তৈরি করবে।

 

এ ছাড়াও, তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর মধ্যে যেসব প্রতিষ্ঠানের ১০% এর কম শেয়ার সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে রয়েছে, তাদের জন্য ২৭.৫% করহার পুনরায় প্রবর্তন করাকে ফিকি বৈষম্যমূলক বলে অভিহিত করেছে। এছাড়াও, নগদবিহীন লেনদেন করা কোম্পানিগুলোর জন্য হ্রাসকৃত হারের করের সুবিধা প্রত্যাহার করা হয়েছে। ফিকি মনে করে, এটি পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং একটি আনুষ্ঠানিক অর্থনীতি গঠনের লক্ষ্যের অন্তরায়।

 

চেম্বার আরও উল্লেখ করে যে, অনলাইন বিক্রয় খাতে ভ্যাটহার ৫% থেকে ১৫%-এ বৃদ্ধি করায় বাংলাদেশের উদীয়মান ডিজিটাল বাণিজ্য খাতের প্রবৃদ্ধি মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হতে পারে। একইভাবে, বেভারেজ কনসেন্ট্রেটের উপর কাস্টমস ডিউটি ১০% থেকে ১৫%-এ বাড়ানোর ফলে পণ্যমূল্য ও শিল্পখাতের মুনাফার মার্জিন ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

 

ফিকি দীর্ঘদিন ধরে একটি সরলীকৃত ও সুশৃঙ্খল ভ্যাট ব্যবস্থার পক্ষে মত দিয়ে আসছে, যেখানে একক হার ও মানসম্মত ইনপুট ট্যাক্স ক্রেডিট ব্যবস্থা থাকবে। কর প্রশাসনে অটোমেশনের মাধ্যমে ডিজিটাল রূপান্তর এবং ন্যাশনাল সিঙ্গেল উইন্ডো বাস্তবায়নের জন্য সরকারের প্রচেষ্টাকে ফিকি সাধুবাদ জানিয়েছে।

 

এনবিআরের মাধ্যমে ৪,৯৯,০০০ কোটি টাকা (মোট রাজস্বের ৮৮%) আহরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করায় সরকারকে সাধুবাদ জানিয়েছে ফিকি। কর প্রশাসনকে আধুনিকায়ন এবং কর নীতি ও কর আদায়ের কার্যক্রম পৃথক করার উদ্যোগকেও চেম্বার স্বাগত জানিয়েছে। তবে, চেম্বার বাস্তবসম্মত রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ এবং কার্যকর বাস্তবায়ন পরিকল্পনার প্রয়োজনীয়তার উপর গুরুত্বারোপ করেছে, যাতে নিয়মিত করদাতাদের ওপর অযাচিত চাপ সৃষ্টি না হয়।

 

অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের তুলনায় জিডিপি প্রবৃদ্ধি আনুমানিক ১৫৭ বেসিস পয়েন্ট বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে এবং ২০২৫ সালের জুন নাগাদ মূল্যস্ফীতি দুই অঙ্ক থেকে নেমে ৮ শতাংশে পৌঁছাবে বলে আশা করা হচ্ছে। এই ইতিবাচক সামষ্টিক অর্থনীতির পূর্বাভাস থাকা সত্ত্বেও, সর্বনিম্ন করহার বৃদ্ধি ও ব্যক্তি ও কর্পোরেট খাতে অতিরিক্ত চাপ পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করতে পারে বলে সতর্ক করেছে ফিকি।

 

ফিকি আবারও অন্তর্ভুক্তিমূলক করনীতি সংস্কার, স্থিতিশীল ও নির্ভরশীল কর পরিবেশ এবং একটি যৌক্তিক করহার কাঠামোর প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দিয়েছে, যা কর পরিপালন ও বিনিয়োগকে উৎসাহিত করবে। সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন চেম্বারের উপদেষ্টা এবং সাবেক সভাপতি রূপালী হক চৌধুরী এবং নাসের এজাজ বিজয়, নির্বাহি পরিচালক টি আই এম নুরুল কবির।

 

ফিকি সম্পর্কে
বাংলাদেশে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের শীর্ষ সংগঠন দ্য ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ফিকি) ১৯৬৩ সালে যাত্রা শুরুর পর থেকে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিসহ সার্বিক উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে। বাংলাদেশের ২১টি খাতে ব্যবসা চালিয়ে যাওয়া বিশ্বের ৩৫টি দেশের প্রায় ২১০টি সদস্য প্রতিষ্ঠান শীর্ষস্থানীয় চেম্বার ফিকির প্রতিনিধিত্ব করছে। ছয় দশকের এই গৌরবময় যাত্রায় চেম্বারের সদস্য প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারের অভ্যন্তরীণ প্রায় ৩০% রাজস্ব আয়ে অবদান রাখছে এবং বাংলাদেশে ৯০% এর বেশি অভ্যন্তরীণ এফডিআই-এর প্রতিনিধিত্ব করছে।