বেড়েছে উৎপাদন খরচ
কমেছে তালিকাভুক্ত কোম্পানির মুনাফা
শাহ আলম নূর : বিশ্ব অর্থনীতি টালমাটাল। বেড়েছে জ্বালানির দাম। একই সাথে কাঁচা মালের দাম উর্ধ্বমুখি। এতে বেড়েছে উৎপাদন খরচ। এর প্রভাব পড়েছে মুনাফায়।
দেশের শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত উৎপাদন ও সেবা খাতের দেশীয় ও বিদেশী কোম্পানিগুলোর মধ্যে অধিকাংশের চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে খারাপ গেছে। এ কারণে জুন ক্লোজিং এসব কোম্পানির নিট মুনাফা ও শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস) কমেছে। সার্বিক হিসাবে নিট মুনাফায় ধ্বস নেমেছে অধিকাংশ কোম্পানির।
পুঁজিবাজারে প্রকৌশল খাতে তালিকাভুক্ত কোম্পানি সিঙ্গার বাংলাদেশের পরিচালনা পর্ষদ দ্বিতীয় প্রান্তিক (এপ্রিল-জুন, ২২) ও অর্ধবার্ষিক (জানুয়ারি-জুন, ২২) অনিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী অর্ধবার্ষিকে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি মুনাফা (ইপিএস) ৫০.৭৫ শতাংশ কমেছে।
তথ্য মতে, চলতি অর্থবছরের ৬ মাসে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি মুনাফা হয়েছে ২.৩১ টাকা। আগের বছরের একই সময়ে কোম্পানিটির ইপিএস ছিল ৪.৬৯ টাকা। সেই হিসাবে কোম্পানিটির মুনাফা ২.৩৮ টাকা বা ৫০.৭৫ শতাংশ কমেছে।
এদিকে, চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি মুনাফা (ইপিএস) হয়েছে ১.৪০ টাকা। আগের বছর একই সময়ে কোম্পানিটির ইপিএস হয়েছিল ২.৮৯ টাকা। সেই হিসাবে কোম্পানিটির মুনাফা ১.৪৯ টাকা বা ৫১.৫৫ শতাংশ কমেছে।
২০২২ সালের ৩০ জুন কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি সম্পদ (এনএভিপিএস) দাঁড়িয়েছে ৩০.৩৮ টাকায়।
মঙ্গলবার কোম্পানির বোর্ড সভায় অনুমোদিত বোর্ড সভায় অনুমোদিত সর্বশেষ আর্থিক বিবরণী অনুসারে ২০২২ সালের দ্বিতীয় প্রান্তিকে লেনদেন আগের বছরের তুলনায় ৯.৪০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ৫৩৫ কোটি টাকা হয়েছে।
কিন্তু কাঁচামালের ক্রমবর্ধমান আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ায় কোম্পানির উৎপাদন খরচ ১৫% বৃদ্ধি পেয়েছে। যা তার বিক্রয় মূল্যের সাথে পুরোপুরি সামঞ্জস্য করা যায়নি।
কারখানার স্তরের মুনাফা হ্রাস, কার্যক্ষম ব্যয়ে বছরের পর বছর বৃদ্ধি, অন্যান্য আয়ের হ্রাস এবং অর্থ ব্যয়ের তীব্র বৃদ্ধি দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে সিঙ্গারের নীচের লাইনে আঘাত করেছে, কোম্পানির সূত্র জানিয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলেছেন যে ২০২১ সালের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে, সমগ্র শিল্পটি উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির সম্মুখীন হয়েছে কারণ সমস্ত ধরণের কাঁচামাল বিশ্ব বাজারে আরও দামী হচ্ছে।
এদিকে চলতি হিসাব বছরের প্রথম তিন প্রান্তিকে (জুলাই-মার্চ) পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ওয়ালটন হাই-টেক ইন্ডাস্ট্রিজ পিএলসির আয় বাড়লেও কর-পরবর্তী নিট মুনাফা কমেছে।
মূলত বৈশ্বিক বাজারে কাঁচামালের দাম বাড়ার পাশাপাশি জাহাজীকরণ বাবদ ব্যয় বেড়ে যাওয়ার প্রভাবে কোম্পানিটির মুনাফা কমে গিয়েছে। অবশ্য এ বছরের শুরু থেকেই পণ্যের দাম বাড়ানোর মাধ্যমে বাড়তি ব্যয় সমন্বয় করা শুরু হয়েছে। চলতি হিসাব বছরের শেষ প্রান্তিকে এর সুফল পাওয়া যাবে বলে কোম্পানিটির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
প্রতিবেদন অনুসারে চলতি হিসাব বছরের প্রথম নয় মাসে ওয়ালটন হাই-টেক ইন্ডাস্ট্রিজের আয় হয়েছে ৫ হাজার ৩৬০ কোটি টাকা। যেখানে আগের হিসাব বছরের একই সময়ে আয় ছিল ৪ হাজার ২৯১ কোটি টাকা।
এক বছরের ব্যবধানে কোম্পানিটির আয় বেড়েছে ১ হাজার ৬৮ কোটি টাকা বা ২৪ দশমিক ৯০ শতাংশ।
আয়ের পাশাপাশি প্রথম তিন প্রান্তিকে কোম্পানিটির উৎপাদন ব্যয় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেড়েছে। আলোচ্য সময়ে কোম্পানিটির পণ্য উৎপাদনে ব্যয় হয়েছে ৩ হাজার ৭১২ কোটি টাকা।
যেখানে আগের হিসাব বছরের একই সময়ে এ খাতে ব্যয় হয়েছিল ২ হাজার ৬০১ কোটি টাকা। এক বছরের ব্যবধানে এ খাতে ব্যয় বেড়েছে ১ হাজার ১১১ কোটি টাকা বা ৪২ দশমিক ৭১ শতাংশ। একই সময়ে কোম্পানিটির পরিচালন ব্যয়ও উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেড়েছে। উৎপাদন ও পরিচালন ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ায় কোম্পানিটির কর-পরবর্তী নিট মুনাফায় বড় প্রভাব পড়েছে।
অনিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, চলতি হিসাব বছরের প্রথম তিন প্রান্তিকে ওয়ালটন হাই-টেক ইন্ডাস্ট্রিজের কর-পরবর্তী নিট মুনাফা হয়েছে প্রায় ৮২০ কোটি টাকা। যেখানে আগের বছরের একই সময়ে নিট মুনাফা ছিল ১ হাজার ৩৩ কোটি টাকা।
এক বছরের ব্যবধানে কোম্পানিটির নিট মুনাফা কমেছে ২১৩ কোটি ৬৭ লাখ টাকা বা ২০ দশমিক ৬৭ শতাংশ। আলোচ্য সময়ে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস) হয়েছে ২৭ টাকা ৭ পয়সা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৩৪ টাকা ২৬ পয়সা।
ওয়ালটন হাইটেক ইন্ডাস্ট্রিজের কোম্পানির এক কর্মকর্তা বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের দাম বাড়ার পাশাপাশি জাহাজীকরণ বাবদ ব্যয় বেড়ে গেছে। এদিকে শুধু ডলারের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় কাঁচামাল আমদানি বাবদ ব্যায় বেড়েছে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা। বাড়তি এ ব্যয় সমন্বয় করতে মুনাফার উপর প্রভাব পড়েছে বলে তিনি মনে করেন।
সিমেন্ট খাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, ক্লিংকার তৈরির খরচ বাড়ায় রফতানিকারক পর্যায়ে দাম বেড়েছে। আবার জাহাজ ভাড়া বাড়ায় তা আমদানি মূল্যের সঙ্গে যোগ হচ্ছে। সিমেন্ট উৎপাদনে প্রধান পাঁচটি কাঁচামাল ক্লিংকার, স্ল্যাগ, জিপসাম, লাইমস্টোন ব্যবহূত হয়, যার সবগুলোই আমদানিনির্ভর।
এক সপ্তাহ আগে বিশ্ববাজারে সিমেন্ট উৎপাদনে ব্যবহূত মৌলিক কাঁচামাল ক্লিংকার টনপ্রতি ৫৫ ডলারে বিক্রি হলেও এখন সেটি ৭০ ডলারের উন্নীত হয়েছে। ১০ থেকে ১২ দিনের ব্যবধানে স্ল্যাগ ১০ ডলার বেড়ে এখন ৪০ ডলারে, জিপসাম ৫ ডলার বেড়ে এখন ৪৫ ডলার, লাইম স্টোন ১০ ডলার বেড়ে ৩৮ ডলারে উন্নীত হয়েছে। একইভাবে ক্লিংকার তৈরিতে ব্যবহূত কাঁচামাল কয়লার দামও বেড়েছে।
পুঁজিবাজারে তালিকা একটি সিমেন্ট কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, যুদ্ধ পরিস্থিতি গোটা সরবরাহ চেইন ব্যবস্থাপনাকেই ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে সিমেন্টের কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি ও জাহাজ ভাড়া বৃদ্ধির কারণে সিমেন্টের উৎপাদন খরচ বেড়েছে। এটা প্রতিনিয়তই বেড়ে চলেছে। বৈশ্বিক এখন যে পরিস্থিতি, সেটি অব্যাহত থাকলে সরবরাহ ব্যবস্থা ক্রমান্বয়ে আরো খারাপের দিকে যেতে থাকবে। যেটি বড় একটি সংকট তৈরি করবে।
কাঁচামালের ঊর্ধ্বগতিতে এখন দেশের বাজারে পণ্যের দাম বাড়ছে। সেখানে কারো কিছুই করার নেই। নির্মাণ খাতের অন্যতম উপকরণটির কারণে যাতে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাধাগ্রস্ত না হয়, সেজন্য করভার কমিয়ে আনতে হবে। শুধু সরকার চাইলে শুল্কহার কমিয়ে এ পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি করতে পারে।
/এসএ