নারী ও শিশুর জীবনে জলবায়ু পরিবর্তনের বহুমাত্রিক প্রভাব
শাহ আলম নূর : বাংলাদেশ হচ্ছে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ সক্রিয় বদ্বীপ, যার গঠন প্রক্রিয়া এখনো চলছে। ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণেই প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ এ দেশ। ঝড়, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস বছরজুড়েই লেগে থাকে। আজ থেকে প্রায় ৫০ বছর আগে ১৯৭০-এর ১২ নভেম্বর আমাদের উপকূলীয় অঞ্চলে ভয়াল ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে ১০ লক্ষাধিক লোকের মৃত্যু হয়েছিল। ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষয়ক্ষতি আজও মানুষের মনে ও ইতিহাসের পাতায় গেঁথে আছে। বাংলাদেশে এখনো প্রতি বছর ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাস হয়। কিন্তু যে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি আগে হতো, এখন গৃহীত পদক্ষেপের কারণে আগের মতো ক্ষয়ক্ষতি হয় না, এ কথা সত্য। তবে ৫০ বছর পর আজ তার পার্থক্য হলো এ রকম দুর্যোগের মাত্রা ও তীব্রতা বেড়েছে বহুলাংশে। এর কারণ হিসেবে দায়ী করা হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবকে।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণ ও তার তাত্ত্বিক দিকের আলোচনাটি এখন তুলে রাখতে চাই এজন্য নয় যে এর কোনো গুরুত্ব নেই, বরং এটি যেমন অনেকখানি আমাদের ইচ্ছা, অনিচ্ছা ও নিয়ন্ত্রণের বাইরে, তেমনি এর ব্যাখ্যায় অধিকতর বিজ্ঞানভিত্তিক বিশ্লেষণ প্রয়োজন এবং তা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংশ্লিষ্ট মহল থেকে করাও হচ্ছে। কারণ যাই হোক আর প্রধান দায়ী যারাই হোক না কেন এর অল্প বিস্তর নেতিবাচক প্রভাব বিশ্বজুড়েই পড়ছে, যা আমাদের দেশে অনেক বেশি প্রখর ও দৃশ্যমান। প্রভাবের দিকটি নিয়ে বলার শুরুতে মনে করাতে চাই যে পৃথিবীর সর্বদক্ষিণের নিম্নভূমিতে অবস্থান বলে বাংলাদেশে দুর্যোগের মাত্রা যেমন অধিকতর, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি, একইভাবে বদলেছে দুর্যোগের ধরন।
সাধারণত জলবায়ু পরিবর্তনের প্রত্যক্ষ প্রভাবে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে জীবন ও ফসলহানি, স্বাস্থ্যঝুঁকি ও বাস্তুচ্যুতিসহ বিভিন্ন সমস্যা তৈরি হয়। দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবে ঋতুচক্র বদলে যাচ্ছে, ক্রমেই স্পষ্ট হয়েছে পরিবর্তন, যেমন অধিকতর উষ্ণ ও দীর্ঘমেয়াদি গ্রীষ্ম, বিলম্বিত ও দীর্ঘায়িত বর্ষা মৌসুমে অতি বা অনাবৃষ্টি, অন্যদিকে প্রায় অনুপস্থিত শরৎ, ক্ষণে ক্ষণে তীব্র শৈত্যপ্রবাহ সহযোগে স্বল্পমেয়াদের শীত মৌসুম। বন্যা, খরা, জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ হানা দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। প্রভাব পড়েছে জল, জঙ্গল ও জমিনে যার মধ্যে উপকূলীয় অঞ্চল হচ্ছে গভীরতম ক্ষতের জায়গা। ঘন ঘন জলোচ্ছ্বাসে সাগরের নোনা পানি প্রবেশ ও তা লম্বা সময় ধরে আটকে থাকার কারণে জমিতে যেমন লবণাক্ততা বেড়েছে; তেমনি খুলনা, বাগেরহাটসহ দক্ষিণাঞ্চলের অনেক জেলায় প্রকট হয়েছে সুপেয় পানির অভাব। উষ্ণায়ন ও তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে গতানুগতিক চাষাবাদ ব্যাহত হচ্ছে, ফলে ব্যাহত হচ্ছে খাদ্য উৎপাদন। উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাওয়ায় অনেক রকমের ফসল উৎপাদন এখন আর সম্ভব হচ্ছে না।
আবহাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এ ঋতুচক্রের অস্বাভাবিক বদলের চূড়ান্ত নেতিবাচক প্রভাব সব মানুষের জীবন ও জীবিকায় পড়েছে আর তার খেসারত গুনতে হচ্ছে প্রধানত নারী ও শিশুদের। পরিবারের গৃহস্থালি কাজের জন্য প্রতিদিন সুপেয় পানির প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে মাইলের পর মাইল হাঁটতে হচ্ছে নারী ও কন্যাশিশুটিকে। ইউনিসেফের ২০১৩ সালের একটি জরিপে পানি সংগ্রহে নারী-পুরুষের ভূমিকার ভিন্নতা দেখা গেছে। ৮৯ দশমিক ৬ শতাংশ নারী পরিবারের জন্য পানি সংগ্রহ করেন। অন্যদিকে এ দায়িত্ব পালন করেন মাত্র ৪ দশমিক ৬ শতাংশ পুরুষ। লবণাক্ত পানি ব্যবহারের ফলে নারীর প্রজনন স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়েছে। আইসিডিডিআর,বির এক গবেষণায় বিজ্ঞানীরা বলছেন, খাবার পানির সঙ্গে যে পরিমাণ লবণ নারীদের দেহে প্রবেশ করছে তার প্রভাবে দেশের অন্য অঞ্চলের তুলনায় উপকূলীয় অঞ্চলের নারীদের গর্ভপাত বেশি হয়। ২০১২ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত পরিচালিত এ গবেষণায় দেখা যায়, সমুদ্র উপকূলের ২০ কিলোমিটার এলাকা এবং সমুদ্র তটরেখা থেকে সাত মিটার উচ্চতায় যারা বসবাস করে, তাদের গর্ভপাতের ঝুঁকি অন্যদের চেয়ে ১ দশমিক ৩ গুণ বেশি।
এছাড়া উপকূলীয় অঞ্চলে যেসব নারী চিংড়ি রেণুপোনা সংগ্রহের কাজ করে তাদেরও প্রজনন স্বাস্থ্যের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। মাত্রাতিরিক্ত লোনা পানির দৈনন্দিন ব্যবহারের ফলে জরায়ুসংক্রান্ত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন উপকূলীয় অঞ্চলে বসবাসকারী নারীরা। সেজন্য অল্প বয়সেই জরায়ু কেটে ফেলতে বাধ্য হচ্ছেন এ এলাকার অনেক নারীই। দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা করানোর মতো অর্থনৈতিক সচ্ছলতা না থাকার কারণে বেশির ভাগ প্রান্তিক নারী জরায়ু কেটে ফেলাকেই স্থায়ী সমাধান মনে করেছেন। কিন্তু এর ফলে তাদের শারীরিক, মানসিক ও সাংসারিক সমস্যা আরো বেড়ে যাচ্ছে। অনেকের সংসারই ভেঙে যায়।
অন্যদিকে, ঝড়, বন্যা, জলোচ্ছ্বাসের কারণে নদীভাঙন বেড়েছে। নদী পারের মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে শহরাঞ্চলে গার্মেন্টস ও নির্মাণ শিল্প ইত্যাদি খাতে চাকরির সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন এবং সেখানে তারা আর্থিকভাবে কিছুটা স্বস্তিতে থাকলেও অনেকেই আরেকবার হয়রানির শিকার হচ্ছেন। চাকরি ও সন্তান লালন একই সঙ্গে সম্ভব হয় না বলে গ্রামে নিকটজনের কাছে রেখে পরিবারের কাছ থেকে দূরে থাকছেন। যেটি একদিকে তাকে, আর অন্যদিকে তার পরিবারকে মানসিক কষ্টে রাখে। এছাড়া গ্রামীণ নারী অভিবাসী শ্রমিক হয়ে পাড়ি দিচ্ছেন দূরদেশে। কখনোবা পাচার হয়ে যাচ্ছেন অজানা গন্তব্যে। এর সবগুলোরই একমাত্র কারণ জলবায়ু পরিবর্তন না হলেও অনেক ক্ষেত্রে এটি প্রধান কারণ হিসেবে এরই মধ্যে চিহ্নিত হয়েছে। এগুলো তাদের এক ধরনের অভিযোজনের বহুমাত্রিক উপায়। বয়সভেদে নারী ও কন্যাশিশুর ওপর ভিন্ন ভিন্ন প্রভাব পড়ে, যেখানে মাধ্যমিক ও উচ্চপর্যায়ের শিক্ষা থেকে কন্যাশিশুর ঝরে পড়া ও বাল্যবিবাহও বাদ পড়েনি।
বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ বাস করে উপকূলে, যাদের জীবিকার প্রধান বা একমাত্র উপাদান হচ্ছে কৃষি। বর্তমানে কৃষি থেকে যে খাদ্যশস্য উৎপাদন হয় তা দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা এনে দিয়েছে, কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন ভবিষ্যতে এ ধারা অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রে বড়সড় চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলবে। বিশেষত ২০৫০ সালের মধ্যে যে চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা আছে, সেটা ৮ শতাংশ এবং গম উৎপাদন কমবে ৩২ শতাংশ। সুতরাং সময় উপযোগী পর্যাপ্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা না গেলে এখন খাদ্যে যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা আছে, আমরা হয়তো তা ধরে রাখতে পারব না। আর তাতে যে নারী ও শিশুরাই অধিক হারে ক্ষতিগ্রস্ত হবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
এ কথা প্রমাণিত সত্য যে সারা দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের জীবিকার প্রধান উৎস কৃষি। উপকূল ছাড়া সারা দেশের কৃষিও এ নেতিবাচক প্রভাবের শিকার।
কৃষিশুমারি ২০১৯ অনুযায়ী বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় মোট ৯৮.৬৬ শতাংশ পরিবার পল্লী এলাকায় বসবাস করে। যার মধ্যে ৫৩.৮২ শতাংশ কৃষি পরিবার। বর্তমানে দেশের মোট শ্রমজীবী মানুষের ৪০.৬ শতাংশ কৃষির সঙ্গে যুক্ত; এদের মধ্যে ৭২.৬ শতাংশ নারী। শ্রম জরিপ প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০১০ সালের তুলনায় ২০১৭ সালে এসে কৃষিতে নারীর সংশ্লিষ্টতা ৬৮.৮৪ শতাংশ থেকে বেড়ে ৭২.৬ শতাংশ হয়েছে। কৃষিতে নারী কৃষকরা যে ধরনের পরিবর্তন নিয়ে এসেছেন তা দেশের বিভিন্ন জায়গার উদাহরণ থেকে উল্লেখ করা যায়। নারী কৃষকরা মূলত খাদ্যশস্য উৎপাদন করছেন, জৈব কৃষি চর্চা করছেন। ফলে মাটির গুণাগুণ বৃদ্ধি পাচ্ছে, ভূমির সঠিক ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে, নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন হচ্ছে। আর এ কৃষি যখন হুমকিতে পড়ে তখন নারীরা বরাবরের মতোই অধিকতর ক্ষুধা ও অপুষ্টিতে ভোগেন।
গ্রামীণ নারী কৃষকরা পরিবারের পুষ্টি সরবরাহ করলেও নিজেরাই পুষ্টিহীনতার শিকার। বাংলাদেশে ৫০ শতাংশের বেশি নারীই পুষ্টিহীনতায় ভুগছেন। ফুড সিকিউরিটি নিউট্রিশনাল সার্ভেলেন্স প্রোগ্রামের (এফএসএনএসপি) এক জরিপে দেখা গেছে, দেশে বয়সের তুলনায় খর্বাকৃতি কিশোরীর হার ৩২ শতাংশ, খর্বাকৃতি নারীর হার ৪২ শতাংশ, খাদ্যে কম পুষ্টি গ্রহণকারী নারীর হার ৬০ শতাংশ। দীর্ঘমেয়াদে শক্তির ঘাটতি আছে এমন নারীর হার ২৫ শতাংশ। এছাড়া দেশের ৪৪ শতাংশ নারী রক্তস্বল্পতায় ভুগছেন। যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ইউএসএআইডি ‘বাংলাদেশের নারী ও শিশুস্বাস্থ্য’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে বলেছে, এ দেশে মায়েদের এক-তৃতীয়াংশ অপুষ্টির শিকার এবং উচ্চতার তুলনায় তাদের ওজন কম। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) ‘পুষ্টি জরিপ-২০১১’তে বলা হয়েছে, এমডিজি বাস্তবায়নকালে বাংলাদেশে খর্বতা, কৃশতা ও কম ওজনসম্পন্ন শিশুদের সংখ্যা কমলেও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে নারীর পুষ্টিহীনতার দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষে।
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় বাংলাদেশ সমন্বিত পুষ্টি প্রকল্প এবং জাতীয় পুষ্টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। এসব প্রকল্পের কার্যক্রম সাফল্য পেলেও এখনো আমাদের দেশের বহু নারী পুষ্টিহীনতায় ভুগছেন।
অঞ্চলভেদে জলবায়ুর প্রভাবে দুর্যোগের ধরন যেমন ভিন্ন, মানুষ ও প্রকৃতিতে তার প্রভাবও ভিন্ন ভিন্ন। ভিন্ন ভিন্ন স্থানে বিভিন্ন সময়ে নারীদের সঙ্গে দেখা ও আলাপচারিতায় তা উঠে এসেছে।
জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশের পার্বত্য তিন জেলার ভূমি, ফসল উৎপাদন ও পানি ব্যবস্থাপনার ব্যাপক পরিবর্তন হওয়ায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন ওই এলাকার নারীরা। এ অঞ্চলের বন উজাড় হওয়ার কারণে পাহাড়ি ছড়াগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে। ফলে পাহাড়ি নারীদের দূরবর্তী অন্য পাহাড় থেকে খাবার পানি সংগ্রহ করতে হচ্ছে। এমনিতেই পাহাড়ি নারীরা পুষ্টিহীনতায় ভোগে, তার ওপর পাহাড়ি উঁচু-নিচু পথ বেয়ে প্রতিদিন পানি সংগ্রহের কারণে তাদের অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়ে। আবার তারা নিরাপত্তাহীন চলাচল পথে প্রায়ই ধর্ষণের শিকার হন। এছাড়া বিগত ২০১৭ সালে টানা অতিবর্ষণে ১২ ও ১৩ জুন রাঙামাটি, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, বান্দরবানে যে ভূমিধস হয়, এতে কমপক্ষে দেড় শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়। এছাড়া কাউখালী, কাপ্তাই, জুরাছড়ি, বিলাইছড়ি, রাজস্থলী ও নানিয়ারচরেও ভূমিধস হয়, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পুরো জেলা। এ সময় ক্ষতিগ্রস্ত পাহাড়ি আদিবাসী নারীরা খেয়ে না খেয়ে কোনো রকমে জীবন ধারণ করেছেন। এমনও হয়েছে যে ধসে পড়া পাহাড়ের মাটি সরাতে আদিবাসী নারীরা নিজেরাই যার যা ছিল তা নিয়ে রাতভর মাটি সরানোর কাজ করেছেন।
এবার আসি হাওড়ের কথায়। কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, সিলেট, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া অর্থাৎ এ সাতটি জেলার প্রায় ৮.৫৮ লাখ হেক্টর জমি নিয়ে হাওড় অঞ্চল গঠিত। বাংলাদেশের মোট ধান উৎপাদনের প্রায় ১৬ শতাংশ আসে হাওড় থেকে। গবেষক ড. আবুল বারকাতের গবেষণায় দেখা গেছে, জিডিপির ২ শতাংশ আসে হাওড়ের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে। হাওড়ে বছরে একবার ফসল (বোরো ধান) হয়। এ সময়ে বছরের ছয়-সাত মাস এলাকায় কাজ থাকে। বাকি সময় মেয়েদের কাজ থাকে না। বছরের পাঁচ-ছয় মাস ঘরে চাল থাকে। বাংলাদেশের বৃহৎ এ হাওড় অঞ্চল এ জলবায়ুর প্রভাবে অকালবন্যায় বাঁধ উপচে বা ভেঙে ফসলি জমি তলিয়ে যাওয়া, মত্স্যসম্পদ, হাঁস ও আরো অন্যান্য জলজ সম্পদ হারানো এখন অনেকটাই ফিবছরের ঘটনা। অন্যসব জায়গার মতো সেখানেও নারী ও শিশুরাই অধিক দুর্ভোগে থাকে। পানিবন্দি অবস্থায় খাদ্য সংকট, যাতায়াত, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা সবই দুর্লভ হয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে জরুরি প্রসূতি সেবার অভাবে অনেক নারীর মৃত্যুও হয়। পানিবাহিত অন্যান্য রোগের দ্রুত চিকিৎসা না পেয়ে শিশুদের মৃত্যু বেড়ে যায়। পরবর্তী সময়ে তারা পুষ্টিহীনতাজনিত অসুখ-বিসুখে ভুগতে থাকে।
বিগত ১৯১৬-১৭ সালে দুই বছর পর পর বন্যা-আগাম বন্যায় হাওড়বাসীর খাদ্য সংকট প্রকট আকার ধারণ করে। এ সময়ে স্থানীয় বাজারেও খাদ্য সংকট হয়। অকালবন্যায় বাঁধ ভেঙে তলিয়ে যায় কাঁচা ধান। চারদিকে পানি থাকায় কোনো শাকসবজি বা লতাপাতাও ছিল না খাওয়ার মতো। বন্যার কারণে গবাদি পশুও খাবারের অভাবে পানির দামে বিক্রি করতে হয়েছে। হাওড় এলাকার সংকট মোকাবেলায় সরকার পরবর্তী সময়ে পরিবারপ্রতি ৩০ মণ চাল, সঙ্গে নগদ ৫০০ টাকা সহায়তা দিয়েছে। তার বিতরণ ব্যবস্থায় নারীরা বৈষম্যের শিকার হয়েছেন। সুনামগঞ্জের তাহিরপুর এলাকার নারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল এ ত্রাণ বিতরণে দুজন পুরুষ বা পুরুষপ্রধান পরিবারের বিপরীতে একজন নারী বা নারীপ্রধান পরিবারকে ত্রাণ দেয়া হয়েছে, অর্থাৎ নারী, পুরুষের অর্ধেক সংখ্যায় ত্রাণ পেয়েছেন, যদিও এটি কোনো সরকারি সিদ্ধান্ত ছিল না। এটি পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতারই স্থানীয় প্রতিফলন। পরিবারের পুরুষ সদস্য এলাকা ছেড়ে অন্য এলাকায় গিয়ে পাথর কোয়ারিতে বালুটানা, পাথরটানার কাজ করছেন। কেউ ভ্যান-রিকশা চালাচ্ছে। সেই বছর একটি বড় সংখ্যায় নারী, পোশাক শ্রমিক হিসেবে ঢাকার গাজীপুর, টঙ্গী, সাভার এলাকায় পাড়ি দেন। যাতায়াত বেড়ে যাওয়ায় সে সময় ঢাকা-সুনামগঞ্জ রুটে বেশিসংখ্যক সরাসরি নাইট কোচ চালু হয়।
এদিকে উদ্বাস্তু হয়ে বর্তমানে ঢাকায় যারা গৃহকর্মী বা নিম্ন আয়ের মানুষ, তাদের বেশির ভাগই এসেছেন জলবায়ুর কারণে ক্ষতিগ্রস্ত বিভিন্ন অঞ্চল থেকে। সমীক্ষায় দেখা গেছে, এদের ৫৬ শতাংশ প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও নদীভাঙনের শিকার। বাকিরা আসছেন উত্তরাঞ্চলের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে। বিগত ২০০৮ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে উদ্বাস্তু হয়েছে দেশের প্রায় ৪৭ লাখ মানুষ। ২০৫০ সালের মধ্যে প্রতি সাতজনের একজন জলবায়ু উদ্বাস্তুতে পরিণত হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
ছোট করে বলতে চাই, যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগকালে নারী ও শিশুরা সব থেকে বেশি ঝুঁকিতে থাকে। সব ঝুঁকি মাথায় নিয়েই সুরক্ষা দিতে সচেষ্ট থাকেন তার পরিবার, এমনকি প্রয়োজনে প্রতিবেশীদেরও। শিশু, বয়োজ্যেষ্ঠসহ সবার আহার, শুশ্রূষা থেকে হাঁসমুরগি ও গবাদি পশু কোনো কিছুই তার নজরদারি থেকে বাদ যায় না। ২০০৯-এর সিডরের উদাহরণ আছে যেখানে নারী তার পাঁচ বছরের সন্তানকে নিয়ে ১৫ কিলোমিটার সাঁতরে পাড়ি দিয়ে ডাঙ্গায় তুলে দিয়েছেন আর পাশেই পড়ে ছিল তার নিথর দেহ, তিনি জীবন হারিয়েছেন। এ রকম উদাহরণের অভাব নেই। কিন্তু এ নারীই দুর্যোগ মোকাবেলায় সর্বাধিক প্রতিকূলতার সম্মুখীন হন। আশ্রয়কেন্দ্রে সন্তান প্রসব থেকে কিশোরী কন্যার বিশেষ দিনগুলো পার করার দুঃসহ অভিজ্ঞতা কোনোটাই বাদ পড়ে না। যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন অনেকেই। তবে এ কথাও সত্য সরকারি ও বেসরকারিভাবে দুর্যোগপূর্ব প্রস্তুতি ও পরবর্তী ব্যবস্থাপনা আগের চেয়ে উন্নত হয়েছে। তার পরও সমন্বিত চিন্তা ও আরো বেশি সুপরিকল্পিত কার্যক্রম জোরদার করতে হবে। এক্ষেত্রে মিডিয়ায় ব্যাপক প্রচার সংশ্লিষ্ট মহলের দৃষ্টি আকর্ষণে সহায়ক হবে।
যেহেতু প্রাকৃতিক দুর্যোগ বন্ধ বা কমিয়ে আনা হাতের মধ্যে নেই তাই মোকাবেলার সক্ষমতা বাড়ানোর দিকে বেশি জোর দিতে হবে। মানবসৃষ্ট দুর্যোগ ভোগান্তির মাত্রা যাতে আরো বাড়িয়ে না তোলে তার জন্য প্রথমত সুন্দরবনে যেকোনো উদ্যোগ নেয়ার ক্ষেত্রে দুবার ভাবতে হবে। কারণ এটি দক্ষিণ উপকূল রক্ষায় বড় ঢাল হিসেবে কাজ করছে। উপকূলের সবুজ বেষ্টনী বাড়ানো, পুরোনো বেড়িবাঁধ নতুন উচ্চতায় মজবুত করে নির্মাণ জরুরি। পার্বত্য চট্টগ্রাম ও অন্যান্য স্থানে পাহাড় কাটা বন্ধ ও সারা দেশে বৃক্ষ নিধন বন্ধ জরুরি।
জলবায়ুসহিষ্ণু ফসলের যেসব নতুন জাত উদ্ভাবন হচ্ছে তার সুফল পেতে কৃষি সেবা, কৃষক, বিশেষত নারী কৃষকের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। উৎপাদিত পণ্যের নিরাপদ সংরক্ষণে কমিউনিটিভিত্তিক উঁচু গোলাঘর নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। মাঠের ফসলের ক্ষতি পোষাতে সারা দেশের কৃষককে শস্যবীমার আওতায় আনতে হবে। এ ক্ষেত্রে নারী কৃষকের অগ্রাধিকার বিবেচনায় নিতে হবে কারণ তারা এখন ৭২.৬ শতাংশ।। দুর্যোগপরবর্তী সময়ে সহায়তা অব্যাহত রাখার পাশাপাশি বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা দরকার। জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা/সুরক্ষার পরিধি বাড়াতে হবে যেখানে ভূমিহীন, আদিবাসী, প্রতিবন্ধীসহ সব বয়স ও শ্রেণী-পেশার দুর্বল অবস্থানের নারী ও শিশুদের অগ্রাধিকার দিতে হবে। দুর্যোগ মোকাবেলায় শক্তিশালী খাদ্য ব্যবস্থা গড়ে তুলতে জাতীয় খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নীতি-২০২০, বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে হবে। জাতীয় জৈব কৃষিনীতি ২০১৬ বাস্তবায়নের দ্রুত ও কার্যকর উদ্যোগ প্রয়োজন। নারী কৃষক অনেক বেশি জৈব কৃষি চর্চা করেন। তাই সহজেই তারা এটির সুফল পাবেন। এছাড়া মন্ত্রিসভা ‘জাতীয় কৃষি সম্প্রসারণ নীতি ২০২০’-এর খসড়া অনুমোদন করেছে। এর আলোকে কৃষক ও উদ্যোক্তাদের চাহিদার ভিত্তিতে প্রযুক্তি ও তথ্য সেবা দেয়ার মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঘাতসহনশীল, পরিবেশবান্ধব, নিরাপদ, টেকসই ও পুষ্টিসমৃদ্ধ লাভজনক ফসল উৎপাদন নিশ্চিত করা অনেকাংশে সম্ভব হবে। এতে নারী ও শিশুরা অনেক বেশি সুরক্ষা পাবে। বেসরকারি সংগঠনগুলো সরকারের পাশাপাশি সচেতনতা বৃদ্ধির কাজ জোরদার করতে পারে। সংবাদমাধ্যমগুলো বছরব্যাপী প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনে আরো বেশি উদ্যোগী হতে পারে। আন্তর্জাতিক মহলে ক্ষতিপূরণ দাবি ও কার্বন নিঃসরণ কমাতে সরকারকে দরকষাকষির দক্ষতা বাড়াতে হবে এবং একই সঙ্গে জনগণের অংশগ্রহণে জলবায়ু তহবিলের স্বচ্ছ ও সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।