অর্থনীতির গতিশীলতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে গতিশীল পুঁজিবাজার
সঠিক বিনিয়োগ মানে সমৃদ্ধ অর্থনীতি। যে দেশের পুঁজিবাজার যত বেশি উন্নত তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা তত ভালো। উন্নত পুঁজিবাজার গঠনে প্রয়োজন যথাযথ নীতি সহায়তা। পুঁজিবাজার পুঁজি সরবরাহ করবে সেটাই যথার্থ এবং এ পুঁজি দেশের শিল্পায়ন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে। উন্নত বিশ্বের পুঁজিবাজারের দিকে তাকালে স্বাভাবিক ভাবেই যেসব দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার ধারনা পাওয়া যায়। কিন্তু বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের দিকে তাকালে দেখা যায় অর্থনীতির বিপরীত চিত্র । বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের জন্মের ইতিহাস প্রায় ৬৮ বছর কিন্তু বিশ্বমানের আশে পাশেও যায়নি তবে আগের চেয়ে উন্নত হয়েছে তা স্বীকার করতে হবে। আমাদের পুঁজিবাজার নিয়ে অপপ্রচারই বেশী। একমাত্র আমাদের দেশেই ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী, ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারী নামে শ্রেণীবিন্যাস করা হয়। আমি মনে করি বিনিয়োগকারী কখনো ক্ষুদ্র হতে পারে না। বিনিয়োগকারীকে ক্ষুদ্র বলা মানে তাকে অসম্মান করা। বিনিয়োগকারীর শ্রেণীভেদ হতে পারে ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক। সেক্ষেত্রে ব্যক্তির চেয়ে প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ সক্ষমতা ও দক্ষতা দুটোই বেশি থাকে।
২০১১ সাল থেকে পুঁজিবাজারে নেতিবাচক অবস্থা ও বিনিয়োগকারীর হতাশা দেখে আসছি। কেন এ হতাশা? বিনিয়োগকারী লাভের আশায় বিনিয়োগ করবে এবং একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত বিনিয়োগ ধারন করবে এবং নির্দিষ্ট সময় পরে সে লভ্যাংশ পাবে এটাই স্বাভাবিক এবং মূল্যবৃদ্ধির কারনে পেতে পারে, মূলধনী লাভও। কিন্তু অস্থির পুঁজিবাজারে তা সম্ভব নয়।
কেন এ অস্থিরতা:- ভালো মানের বৃহদাকার প্রতিষ্ঠানের অভাব, ছোট পুঁজি নিয়ে নিজেকে শেয়ার ব্যবসায়ী হিসেবে চিন্তা করা, দেশীয় মুদ্রার অবমূল্যায়ন, শুধু মুলধনী লাভের প্রতি আগ্রহী হয়ে বিনিয়োগ করা, ব্যাংক সুদের হার বৃদ্ধি তাছাড়া লভ্যাংশের উপর অধিক হারে কর বসানোর ফলে বিনিয়োগকারীগন দীর্ঘ মেয়াদি বিনিয়োগ করতে চায় না।
আমাদের পুঁজিবাজারে বৃহৎ প্রতিষ্ঠানসমূহ তালিকাভূক্তিতে অনাগ্রহ থাকায় মানসম্পন্ন শেয়ারের সংখ্যা তুলনামূলক কম তাই দুর্বল প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তারা সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করে। এ ব্যপারটি শুধুমাত্র দুষ্ট/ দুর্বল উদ্যোক্তাদের উপর নির্ভর করছে না, তার জন্য পারিপার্শ্বিক অবস্থাও দায়ী।
ভালো মৌল ভিত্তি সম্পন্ন প্রতিষ্ঠানকে স্টক এক্সচেঞ্জ এ তালিকাভুক্তির মাধ্যমে পুঁজিবাজারের মান, গভীরতা ও গতিশীলতা বৃদ্ধি করা যায় কিন্তু আমাদের দেশে বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠান এমনকি বহুজাতিক কোম্পানীসমূহও তালিকাভুক্তিতে আগ্রহ নেই। কারণ উদ্যোক্তারা যদি অর্থের প্রয়োজন মনে করেন তারা ব্যাংক থেকে অতি সহজেই জামানত দিয়ে কম সময়ের মধ্যে অর্থের যোগান পেতে পারে। তাছাড়া ঋণের উপর সুদও করমুক্ত ব্যয় হিসাবে দেখানো যায়।
পুঁজিবাজারকে কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌছানোতে অর্থনীতির সহায়ক শক্তি হিসাবে পরিনত করার জন্য নিম্ন বর্ণিত বিষয়াদি গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন:-
১. শিল্পায়ন ও উৎপাদন বৃদ্ধিতে ব্যাংক ঋণ নির্ভরতা কমানো।ব্যাংক ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে একটি নিদিষ্ট সীমার পর পুঁজিবাজারে তালিকাভূক্তির বাধ্যবাধকতা রাখা প্রয়োজন।
২. জামানত নির্ভর ঋণ না দিয়ে ব্যবসার সম্ভাবনা ও উদ্যোক্তার গুণ / মান যাচাইপূর্বক স্বল্পমেয়াদি ঋণ দেওয়া।শুধু জামানত নির্ভর ঋণ; খেলাপি ঋণে পরিনত হচ্ছে।প্রায় দেখা যায় পত্র পত্রিকায় প্রধান শিরোনাম হয় ব্যাংক ঋণের দূর্বলতা বা মন্দাঋণ নিয়ে।
৩. কর কমানো নয়, বরং কর কাঠামো পরিবর্তন করা প্রয়োজন। কর কাঠামো পরিবর্তনে হার সমন্বয় হতে পারে তবে মোট করের পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে।তালিকাভূক্ত কোম্পানির সুশাসন কাঠামো তুলোনামূলক ভাবে ভালো এতে করে সরকারের রাজস্বের পরিমানও বাড়বে।
৪. ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে শুধুমাত্র জামানত নয় কোম্পানীর পরিশোধিত মূলধন ও বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন।যে কোম্পানির পরিশোধিত মূলধন যত বেশী হবে তার অবস্থান ও ততো মজবুত হবে।
৫. ২০০ কোটি টাকার বেশী ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির বিষয়টি বাধ্যবাধকতায় আনা প্রয়োজন এবং এসএমই খাতে ৫০ কোটি টাকার বেশি ঋণের ক্ষেত্রে তালিকাভূক্তির বিষয়টি বিবেচনায় রাখা দরকার।
৬. প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসন নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন এবং তালিকাভুক্তির মাধ্যমে সুশাসন বৃদ্ধি করা সম্ভব।
৭. শুধুমাত্র BSEC একা পুঁজিবাজারের গতি ত্বরান্বিত করতে পারবে না, এখানে BSEC, NBR, IDRA এবং বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয়ের সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। সকল প্রতিষ্ঠান সম্মিলিত ভাবে উদ্যোগ নিলে একটি গতিশীল পুঁজিবাজার তৈরি হবে এবং সরকারের রাজস্ব বহুমাত্রায় বৃদ্ধি পাবে যা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
৮ অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগকে এগিয়ে আসতে হবে উপরোক্ত প্রতিষ্ঠান গুলিকে সমন্বয় সাধন করার লক্ষ্যে।
৯. সহজ সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে পুঁজিবাজার ও নিয়ন্ত্রকদের নিয়ে অপপ্রচার বন্ধের বিষয়ে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন।
উপরোক্ত বিষয়াদি ছাড়াও নিম্নের বিষয়াদিও বিবেচনায় আনতে হবে পুঁজিবাজারের পরিধি বড় করতে হলে:
- লভ্যাংশের উপর করের প্রভাব বাদ দিয়ে পূর্বের ন্যায় লভ্যাংশ বিতরণ কর আরোপ করা হলে সাধারণ বিনিয়োগকারীগণ লভ্যাংশের প্রতি আগ্রহী হবে।
- তালিকাভুক্ত ও অ-তালিকাভুক্ত কোম্পানির করের ব্যবধান বৃদ্ধি করা এবং ২০০ কোটি টাকার বেশি যে সকল প্রতিষ্ঠান ঋণ গ্রহণ করে তাদের জন্য তালিকাভুক্তি বাধ্যতামূলক করা। তাহলে মানসম্পন্ন বৃহত্তর প্রতিষ্ঠানসমূহ বাজারে আসবে এবং বাজারের গভীরতা বাড়বে যা সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
- লোকসানি কোম্পানীকেও তালিকাভুক্তির সুযোগ দেওয়া হলে কোম্পানীর মান নিয়ে প্রশ্ন কমে আসবে। প্রয়োজনে তারা অবহারে শেয়ার অফার করবে।
- স্বাভাবিক ভাবেই পুঁজিবাজারে কোম্পানির তালিকাভূক্তিতে জবাবদিহিতা ও খরচ বৃদ্ধি পায়। বৃহৎ উদ্যোক্তারা পুঁজিবাজারের প্রতি আগ্রহী না হয়ে ব্যাংকের অর্থায়নের প্রতি আগ্রহী হয়।
- তাছাড়াও একটি নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপনের পরে লাভজনক অবস্থায় আসা ও লভ্যাংশ ঘোষণার মত অবস্থানে পৌছাতে ৪/৫ বছর সময় লাগে। কিন্তু পুঁজিবাজার ৪/৫ বছর অপেক্ষা করতে চায় না পুঁজিবাজার প্রতিবছর লভ্যাংশ আশা করে এবং আইনেও তার বাধ্যবাধকতা দেয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ও বাস্তব অবস্থা বিবেচনায় আইন সংশোধন করা প্রয়োজন।
উপরোক্ত বিষয়াদি একজন উদ্যোক্তাকে পুঁজিবাজারে সম্পৃক্ততা হওয়া বা তালিকাভুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে নিরুৎসাহিত করে।
বাংলাদেশে আর্থিক খাতের প্রতিষ্ঠান সমূহ যেমন- ব্যাংক, বীমা, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইত্যাদির জন্য ব্যবসার ৩ বছর পর তালিকাভূক্ত হওয়ার বাধ্যবাধকতা আছে তাই তারা তালিকাভূক্তিতে আসে। কিন্তু অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ও শিল্প কারখানার ক্ষেত্রে এর কোন বাধ্যবাধকতা না থাকায় উদ্যোক্তারা ব্যাংক নির্ভর হচ্ছে এবং প্রতিনিয়ত মন্দ ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
শুধুমাত্র জামানতের ভিত্তিতে ঋণ দেয়ার ধারণা থেকে বের না হলে ব্যাংকের মন্দ ঋণের পরিমাণ কমবে না আর এ মন্দ ঋণ অর্থনীতির গতিকে দুর্বল করে দিবে।
বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন ব্যাংক ঋণের উপর ভিত্তি করে অসাধারণ গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে তবে তা থমকে দাঁড়াতে পারে যদি না নীতি পরিবর্তন করা হয়। তাই অর্থনীতির এ গতিকে ধরে রাখতে পুঁজিবাজারকে অতি দ্রুত সক্রিয় করা জরুরী প্রয়োজন। পুঁজিবাজার গতিশীলতা করতে সংশ্লিষ্টপক্ষ সমূহের সমন্বয়ে যুগোপযোগী আইন/ নীতি প্রয়োজন। আগামীর উন্নত বাংলাদেশ গঠনে পুঁজিবাজার হতে পারে ভরসার জায়গা।
মাহবুবা ইসলাম
সম্পাদক
শেয়ারবাজারনিউজ ডট কম