ডলারের চাপ কমলেও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে স্বস্তিতে নেই ব্যাংক
নিজস্ব প্রতিবেদক: দুই বছর আগের তুলনায় দেশে ডলার প্রবাহে বেশ উন্নতি হয়েছে। আমদানি দায় ও বিদেশী ঋণ পারিশোধের চাপও কমে এসেছে। তবে ডলার সরবরাহ বাড়লেও বৈদেশিক বাণিজ্য নিয়ে স্বস্তিতে নেই দেশের ব্যাংকগুলো। বিদেশী ব্যাংকগুলো ঋণসীমা কমিয়ে দেয়ায় ঋণপত্র (এলসি) খুলতে বিড়ম্বনা বাড়ছে।
‘কান্ট্রি রেটিং’ খারাপ হওয়া ও আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে উন্নীত না হওয়ায় দেশের ব্যাংকগুলোকে ঋণপত্র (এলসি) খুলতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ব্যাংকগুলোর গ্যারান্টির প্রয়োজন হয়। বাংলাদেশের এলসির গ্যারান্টির বড় অংশই দেয় মধ্যপ্রাচ্যের ব্যাংকগুলো। ভারত ও ইউরোপ-আমেরিকার বৃহৎ ব্যাংকগুলোও কিছু এলসির গ্যারান্টর হয়। এজন্য বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর জন্য একটি ঋণসীমা অনুমোদিত থাকে।
ডলার সংকটের কারণে দুই বছর ধরেই বিদেশী ব্যাংকগুলো বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর জন্য তাদের ঋণসীমা কমিয়ে এনেছে। গত ৫ আগস্টের পর এ পরিস্থিতি আরো বেশি নাজুক হয়েছে। ১১টি বেসরকারি ব্যাংকের পর্ষদ ভেঙে দেয়া, তারল্য সংকট ও নানা নেতিবাচক প্রচারণার কারণে বিদেশী অনেক ব্যাংকই বাংলাদেশের কিছু ব্যাংকের এলসি নিচ্ছে না। যে ব্যাংকগুলোর আর্থিক সক্ষমতা বেশ ভালো তাদের জন্যও ঋণসীমা কমিয়ে দেয়া হয়েছে। এলসি খোলার জন্য দেশের ব্যাংকগুলোকে বাড়তি কমিশন বা ফিও গুনতে হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
বিদেশী ব্যাংকগুলো ঋণসীমা কমিয়ে দেয়ায় এলসি খুলতে বিড়ম্বনা পোহাতে হচ্ছে বলে জানান মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ মাহবুবুর রহমান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘এক-দেড় বছর আগের তুলনায় বর্তমানে দেশের ব্যাংক খাতে ডলারের সরবরাহ বেশ ভালো। কিন্তু দেশের কিছু ব্যাংকের নাজুক পরিস্থিতির কারণে বিদেশীদের কাছে খারাপ বার্তা যাচ্ছে। এমনিতেই বাংলাদেশের কান্ট্রি রেটিং খারাপ। তার সঙ্গে ব্যাংক খাতের অস্থিরতা তৈরি হওয়ায় বিদেশী ব্যাংকগুলো ঋণসীমা কমিয়ে দিয়েছে। অর্থনৈতিক স্থবিরতার কারণে এমনিতেই আমদানির চাহিদা কম। যে চাহিদা আসছে, বিদেশী ব্যাংকগুলো ঋণসীমা কমিয়ে দেয়ার কারণে সে এলসিও খোলা যাচ্ছে না।’
সৈয়দ মাহবুবুর রহমান জানান, ‘মধ্যপ্রাচ্যে ভারতীয় মিডিয়ার প্রভাব রয়েছে। আর ভারতীয় মিডিয়ায় বাংলাদেশ সম্পর্কে অতিরঞ্জিত অনেক সংবাদ প্রকাশ হচ্ছে। এসব সংবাদের কারণে বিদেশীরা বিভ্রান্ত হচ্ছেন। মধ্যপ্রাচ্য, ভারতসহ এশিয়া অঞ্চলের কিছু দেশের ব্যাংকগুলো ঋণসীমা কমিয়েছে। তুলনামূলকভাবে ইউরোপ-আমেরিকার ব্যাংকগুলো ভালো সাপোর্ট দিচ্ছে।’
‘থার্ড পার্টি গ্যারান্টি’ হিসেবে আমদানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর সবচেয়ে বেশি ব্যবসা রয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাতভিত্তিক মাশরেক ব্যাংকের সঙ্গে। মধ্যপ্রাচ্যের প্রভাবশালী এ ব্যাংকটি বাংলদেশের বেশির ভাগ ব্যাংকেরই এলসির গ্যারান্টর হয়। রাজনীতির পাশাপাশি ব্যাংক খাতের অস্থিরতার কারণে ব্যাংকটি দেশের অনেক ব্যাংকেরই ঋণসীমা বন্ধ করে দিয়েছে। ভারত, সিঙ্গাপুর, সৌদি আরব, আমিরাতসহ মধ্যপ্রাচ্যের আরো কিছু ব্যাংক ঋণসীমা কমিয়ে দিয়েছে বলে ব্যাংক নির্বাহীরা জানিয়েছেন। ইউরোপের ব্যাংকগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের সঙ্গে সবচেয়ে বেশি ব্যবসা রয়েছে জার্মানির কমার্স ব্যাংকের। এ ব্যাংকও দেশের কিছু ব্যাংকের এলসি নিচ্ছে না। তবে অস্থিরতার মধ্যেও এক্ষেত্রে ভালো ব্যবসা করছে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক বাংলাদেশ। গত বছর বহুজাতিক এ ব্যাংকটির বাংলাদেশ অফিস রেকর্ড পরিমাণ মুনাফা করে। চলতি বছর এলসি কমিশন ও গ্যারান্টর হিসেবে ব্যাংকটির মুনাফা আরো বেড়েছে বলে জানা গেছে।
দেশের ডলার প্রবাহ ও বৈদেশিক বাণিজ্য পরিস্থিতির প্রকৃত চিত্র পাওয়া যায় ‘ব্যালান্স অব পেমেন্ট’ শীর্ষক প্রতিবেদনে, যা বিওপি হিসেবে পরিচিত। বাংলাদেশ ব্যাংকের তৈরি করা বিওপির সর্বশেষ প্রতিবেদন গতকাল প্রকাশ করা হয়। এতে দেখা যায়, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (জুলাই-আগস্ট) দেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের চাপ অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে দেশের আমদানি ব্যয় ছিল ১ হাজার ৩ কোটি ডলার। চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে এ ব্যয় ৯৯১ কোটি ডলারে নেমে এসেছে। এক্ষেত্রে আমদানি ব্যয় কমেছে ১ দশমিক ২ শতাংশ।
আমদানি কমলেও আগের তুলনায় চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে রফতানি আয়ে ২ দশমিক ২৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে রফতানি আয় ছিল ৬৯৮ কোটি ডলার, চলতি অর্থবছরে তা বেড়ে ৭১৬ কোটি ডলারে উন্নীত হয়েছে। আর চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয় বেড়েছে ১৫ দশমিক ৮ শতাংশ। ব্যয়ের তুলনায় ডলার প্রবাহ বাড়ায় সরকারের চলতি হিসাব উদ্বৃত্তের ধারায় ফিরেছে। গত অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে চলতি হিসাবে ৬১ কোটি ডলার ঘাটতি থাকলেও চলতি অর্থবছরের একই সময়ে ১১ কোটি ডলার উদ্বৃত্ত রয়েছে। চলতি অর্থবছরে দেশের আর্থিক হিসাবের (ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট) ঘাটতিও কমেছে। সব মিলিয়ে আগস্ট শেষে বিওপির ঘাটতি ছিল ১৩৯ কোটি ডলার। গত অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে বিওপিতে ১৬৯ কোটি ডলার ঘাটতি ছিল।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে আমদানির এলসি খোলা ১২ দশমিক ৯৬ শতাংশ কমে গেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৪৩ দশমিক ৭১ শতাংশ কমেছে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি। আর আগস্ট পর্যন্ত প্রথম দুই মাসে আমদানির এলসি নিষ্পত্তি কমেছে ১৩ শতাংশেরও বেশি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোসলেহ্ উদ্দীন আহমেদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘দুই বছর আগের তুলনায় দেশে ডলারের সরবরাহ ভালো। অনেক ব্যাংকের কাছেই পর্যাপ্ত ডলার আছে। কিন্তু সমস্যা হলো এলসি সংখ্যা অনেক কমে গেছে। দেশের অর্থনীতি অনেকটাই স্থবির। নতুন বিনিয়োগ নেই বললেই চলে। আবার বিদেশী ব্যাংকগুলোও বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর ঋণসীমা কমিয়ে দিয়েছে। এলসি খোলার কমিশন ও অ্যাড কনফারমেশন রেটও বেড়ে গেছে। ব্যাংক খাত স্থিতিশীল ও শক্তিশালী না হলে এ পরিস্থিতির উন্নতি হবে না।’