আজ: শুক্রবার, ১৮ অক্টোবর ২০২৪ইং, ২রা কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৩ই রবিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি

সর্বশেষ আপডেট:

১৭ অক্টোবর ২০২৪, বৃহস্পতিবার |

kidarkar

ডিমের ‘যৌক্তিক মূল্য’ যেভাবে নির্ধারণ করল সরকার

নিজস্ব প্রতিবেদক: কয়েক দিনের নাটকীয়তার পর শেষ পর্যন্ত রাজধানীতে কাটতে যাচ্ছে ডিমের সংকট। সরকার নির্ধারিত ‘যৌক্তিক’ দামে ডিম বিক্রি করতে সম্মত হয়েছেন উৎপাদক ও পাইকারি বিক্রেতারা। নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ভোক্তারা ১১ টাকা ৮৭ পয়সা দরে কিনতে পারবেন।

এখন থেকে উৎপাদকরা পাইকারি বিক্রেতাদের কাছে প্রতিটি ডিম ১০ টাকা ৫৮ পয়সা দরে (পরিবহন খরচ বাদে) বিক্রি করবেন। পাইকারি বিক্রেতারা এ ডিম খুচরা বিক্রেতাদে দেবেন ১১ টাকা ১ পয়সা দরে।

এর আগে, খামার ও জেলা পর্যায়ের মোকামগুলোতে ডিমের দাম বেশি থাকার কারণ দেখিয়ে সরকার নির্ধারিত দামে ডিম বিক্রি করতে অপারগতা জানান দেশের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার তেজগাঁয়ের ডিমের ব্যবসায়ীরা। গত রোববার থেকে দোকান না খুলে ডিম বেচাকেনা বন্ধ করে দেন তারা।

তেজগাঁয়ের আড়তের ব্যবসায়ীদের দাবি, তাদের ডিম কিনতে হচ্ছে সরকারের বেঁধে দেয়া দামের থেকে বেশি দরে। দেশের বিভিন্ন স্থানের খামার পর্যায়ে এবং ডিমের আড়তগুলোতে দাম রাখা হচ্ছে সরকারের বেঁধে দেয়া দামের থেকে বেশি। তার ওপর পরিবহন খরচ এবং দোকানের অন্যান্য খরচ মিলিয়ে কোনোভাবেই সরকার নির্ধারিত দামে ডিম বিক্রি করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। এ জন্য জরিমানা ও হয়রানি এড়াতে বাধ্য হয়েই বেচাকেনা বন্ধ করে দিতে হয়েছে তাদের।

এদিকে, তেজগাঁয়ের আড়তের ব্যবসায়ীদের এই সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে রোববার থেকে বন্ধ হয়ে যায় রাজধানীর বাইরে থেকে আসা ডিমের ট্রাকের আনাগোনা। ডিমশূন্য হয়ে পড়ে রাজধানীর বৃহত্তম কাঁচাবাজার হিসেবে পরিচিত কারওয়ান বাজার। পাশাপাশি পাড়া-মহল্লার দোকানগুলোতেও উধাও হয় ডিম।

সীমিত আকারে কোনো কোনো দোকানে ডিম মিললেও সেখানে প্রতিটি ডিম বিক্রি হয় ১৬ থেকে ১৮ টাকা দরে। এ পরিস্থিতিতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে দেখা দেয় তীব্র প্রতিক্রিয়া। রাজধানীতে ডিমের এই সংকট ও দাম বৃদ্ধির পেছনে ডিম ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটকেও দায়ী করেন অনেকে। পাশাপাশি পরিস্থিতি সামলাতে ব্যর্থতার জন্য সরকারের সমালোচনাও করেন কেউ কেউ।

এ অবস্থায় পরিস্থিতি সামাল দিতে মাঠে নামে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর। মঙ্গলবার (১৫ অক্টোবর) ডিমের উৎপাদক, পাইকারি বিক্রেতাসহ ডিম বিপণনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের নিয়ে বৈঠকের আয়োজন করে তারা। বৈঠক থেকেই ডিমের সরবরাহ স্বাভাবিক রাখা এবং দাম নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য সব পক্ষের সম্মতিতে রাজধানীর বাজারগুলোতে ডিমের সরবরাহ বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, এখন থেকে রাজধানীর ডিমের দুই প্রধান পাইকারি বাজার তেজগাঁও ও কাপ্তানবাজারে দৈনিক ২০ লাখ ডিম সরবরাহ করবেন করপোরেট উৎপাদকরা। এ দুই আড়তের পাইকারি বিক্রেতাদের তারা ডিম বিক্রি করবেন সরকার নির্ধারিত ‘যৌক্তিক’ দরে।  বিপরীতে পাইকারি বিক্রেতারাও খুচরা বিক্রেতাদের কাছে ডিম বিক্রি করবেন সরকার নির্ধারিত ‘যৌক্তিক’ দরে।

যৌক্তিক এ মূল অনুযায়ী করপোরেট খামারিরা পাইকারি বাজারে প্রতিটি ডিম বিক্রি করবেন ১০ টাকা ৫৮ পয়সা দরে। বিপরীতে পাইকারি বিক্রেতারাও সরকার নির্ধারিত ‘যৌক্তিক’ দরে খুচরা বিক্রেতাদের কাছে ডিম বিক্রি করবেন। পরবর্তী সময়ে খুচরা ব্যবসায়ীরা প্রতিটি ডিম ভোক্তাদের কাছে বিক্রি করবেন ১১ টাকা ৮৭ পয়সা দরে। অর্থাৎ বাজার কিংবা পাড়া-মহল্লার দোকানগুলোতে ডিমের দাম থাকবে ১২ টাকার নিচে। এর ফলে বাজারে ডিমের সরবরাহ স্বাভাবিক হয়ে ডিমের দাম হ্রাস পাবে বলে জানানো হয় বৈঠক থেকে।

সম্প্রতি ডিমের ‘যৌক্তিক দাম’ নির্ধারণ করে দেয় সরকার। গত ১৫ সেপ্টেম্বর প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের মহাপরিচালক (চলতি দায়িত্ব) মোহাম্মদ রেয়াজুল হকের সই করা বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ‘কৃষি বিপণন অধিদফতর, প্রাণিসম্পদ অধিদফতর এবং পোলট্রি সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংস্থা প্রতিষ্ঠানের নেতাদের সমন্বয়ে গঠিত জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের মতামতের ভিত্তিতে কৃষি বিপণন অধিদফতর ২০২৪ সালের ডিমের নির্ধারণকৃত যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণ করেছে।’

নির্ধারিত এ দাম অনুযায়ী খামারে একটি ডিমের উৎপাদন খরচ ধরা হয়েছে ১০ টাকা ১৯ পয়সা। এর সঙ্গে যৌক্তিক লাভ ধরা হয়েছে ৩৯ পয়সা। ফলে উৎপাদক পর্যায়ে ডিমের যৌক্তিক দাম লাভসহ ধরা হয়েছে ১০ টাকা ৫৮ পয়সা। পাইকারি ব্যবসায়ীরা খামার থেকে ১০ টাকা ৫৮ পয়সা দরে ডিম কিনলেও তার সঙ্গে পাইকারি বাজার পর্যন্ত ডিম পৌঁছাতে পরিবহনসহ বিপণন খরচ ধরা হয়েছে ৩৩ পয়সা। সে ক্ষেত্রে পরিবহন ও বিপণনসহ পাইকারি ব্যবসায়ীদের ডিম কিনতে খরচ পড়ছে ১০ টাকা ৯১ পয়সা।

তারা এই ডিম আড়ত থেকে খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করতে পারবেন ১১ টাকা ১ পয়সা দরে। এ ক্ষেত্রে পাইকারি ব্যবসায়ীরা ডিমপ্রতি মুনাফা করতে পারবেন ১০ পয়সা। খুচরা ব্যবসায়ীরা ১১ টাকা ১ পয়সা দরে ডিম কিনে তাদের নিজেদের দোকান পর্যন্ত এই ডিম পৌঁছাতে পরিবহন ও বিপণন খরচ ধরা হয়েছে ডিমপ্রতি ৪২ পয়সা। পাশাপাশি খুচরা ব্যবসায়ীদের ডিমপ্রতি মুনাফা ধরা হয়েছে ৪৩ পয়সা।  এই খরচ এবং মুনাফা যোগ করে খুচরা বিক্রেতারা ভোক্তাদের কাছে ডিম বিক্রি করতে পারবেন ১১ টাকা ৮৭ পয়সা দরে। অর্থাৎ সরকার ভোক্তা পর্যায়ে ডিমের খুচরা মূল্য সর্বোচ্চ ১১ টাকা ৮৭ পয়সা নির্ধারণ করেছে।
সরকার প্রতি এক হাজার লেয়ার মুরগির বাচ্চার ১৮ মাসের উৎপাদন চক্র বিবেচনা করে প্রতিটি ডিমের উৎপাদন খরচ নির্ধারণ করেছে ১০ টাকা ১৯ পয়সা। এ ক্ষেত্রে মোট ১৬টি বিষয়কে বিবেচনা করে কৃষি বিপণন অধিদফতর কর্তৃক এই মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে বলে সময় সংবাদকে জানিয়েছে প্রাণিসম্পদ অধিদফতর সূত্র।

এ ক্ষেত্রে এক হাজার বাচ্চা পালনের জন্য প্রয়োজনীয় শেড নির্মাণ এবং অন্যান্য এককালীন খরচসহ মোট বিনিয়োগ ধরা হয়েছে ১ লাখ ৮৩ হাজার ৫৬৬ টাকা (এ ক্ষেত্রে অবশ্য শেডের স্থায়িত্ব দশ বছর ধরে হিসাব করা হয়েছে)। এর সঙ্গে ১ দিন বয়সি ১ হাজার ‘এ গ্রেড’ বাচ্চার ক্রয়মূল্য ধরা হয়েছে ৫৫ হাজার টাকা। মোট খাদ্য খরচ ধরা হয়েছে ৩৪ লাখ ৮০ হাজার টাকা। ওষুধ, টিকা ও ভ্যাকসিন খরচ ধরা হয়েছে ১ লাখ ৯৫ হাজার টাকা।

এছাড়া, জীবাণুনাশক ওষুধ ক্রয় খরচ (শেড ক্লিনিং) বাবদ খরচ ধরা হয়েছে ২৫ হাজার টাকা। খামার রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামত খরচ ধরা হয়েছে ১৬ হাজার ৫২৩ টাকা। কর্মচারীদের বেতন ও শ্রমিক খরচ ধরা হয়েছে ৩ লাখ টাকা। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খরচ ধরা হয়েছে ২ লাখ ৭৬ হাজার ১২৯ টাকা। পরিবহন খরচ ধরা হয়েছে ৫ হাজার ৫০০ টাকা। ধানের তুস, কাঠের গুঁড়ার ক্রয় খরচ ধরা হয়েছে ৪ হাজার ৫০০ টাকা।

আর অন্যান্য খরচ ধরা হয়েছে ১ হাজার ৫০০ টাকা। সব মিলিয়ে ১ হাজার বাচ্চা থেকে প্রাপ্ত ডিমের উৎপাদন খরচ ধরা হয়েছে ৪৩ লাখ ৫৯ হাজার ১৫২ টাকা। তবে উপজাত হিসেবে মুরগি বিক্রি ও বস্তা বিক্রি বাবদ আয় বাদ দিয়ে নিট উৎপাদন খরচ ধরা হয়েছে ৪০ লাখ ২৩ হাজার ২৭৮ টাকা। প্রতি ১ হাজার বাচ্চার এক একটি ব্যাচে সর্বমোট উৎপাদন ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৯৫ হাজারটি ডিম। এখন নিট উৎপাদন খরচকে এক হাজার মুরগির সর্বমোট ডিম উৎপাদন দিয়ে ভাগ করলে প্রতিটি ডিমের উৎপাদন খরচ পড়ে ১০ টাকা ১৯ পয়সা।

আপনার মতামত দিন

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.