হিরু চক্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে অর্থ মন্ত্রণালয়ে বিএসইসির চিঠি
নিজস্ব প্রতিবেদক: পুঁজিবাজারে কারসাজি চক্রের মূল হোতা আবুল খায়ের হিরু। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে আবুল খায়ের, তার পরিবারের সদস্য এবং সহযোগীদের নাম উঠে এলেও কারো বিরুদ্ধে তেমন কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। কিন্তু হাসিনা সরকারের পতনের পর হিরুসহ তার পরিবারের সদস্যদের ব্যাংক হিসাবের পাশাপাশি শেয়ার লেনদেনের বিও হিসাব জব্দ করা হয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) দেশের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে এ সংক্রান্ত নির্দেশনা পাঠিয়ে ব্যাংক হিসাবের যাবতীয় তথ্য চেয়েছে।
হিরু ও তার সিন্ডিকেটের এসব অনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের তথ্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে পাঠিয়েছে পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।
গত ৭ অক্টোবর অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব বরাবর ‘পুঁজিবাজারে বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ার লেনদেনে কারসাজি এবং এ সম্পর্কিত বিষয়ে আবুল খায়ের ও তার সহযোগীদের ওপর আরোপিত অর্থদণ্ড’ প্রসঙ্গে চিঠি পাঠানো হয়েছে বলে মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।
একই সঙ্গে পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের সচিব, সমবায় অধিদপ্তরের নিবন্ধক ও মহাপরিচালক এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টাকে বিষয়টি অবহিত করা হয়েছে।
শেয়ার কারসাজির অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় সমবায় আবুল খায়ের হিরু এবং তার সহযোগীদেরকে এ পর্যন্ত মোট ১৪ কোটি ৫৯ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। ২০১৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে ১২টির বেশি কোম্পানির শেয়ার নিয়ে কারসাজি করায় আবুল খায়ের হিরু ও তার সহযোগীদের জরিমানা করা হয়।
পুনর্গঠিত বিএসইসির চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদের নেতৃত্বাধীন নতুন কমিশন আবুল খায়ের ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়েছে, উল্লিখিত বিষয়ে নির্দেশিত হয়ে জানানো যাচ্ছে যে, মো. আবুল খায়ের পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারী। তার পরিচালিত বেনিফিশিয়ারি ওনার্স (বিও) অ্যাকাউন্ট নম্বরগুলো হলো: ১২০১৯৫০০৬২১৬৪৫৩৫, ১২০২৬০০০৭১০৯১১১৬, ১২০৪৫৯০০৬৭৭১২৭৮১, ১২০৫৫৯০০৭১০৯১১১৬, ১২০৫৯৫০০৭১০৯১১১৬, ১৬০৪৫৩০০৬২১৬৪৫৩৫ ও ১৬০৫১১০০৭১০৯১১১৬। তিনি সরকারি কর্মচারী, সমবায় অধিদপ্তরে উপ-নিবন্ধক (ইপি) হিসেবে কর্মরত আছেন। তিনি সহযোগীদের নিয়ে বিভিন্ন সময়ে পুঁজিবাজারে বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ার লেনদেনে করসাজি করেছেন। ফলে, পুঁজিবাজারের সাধারণ বিনিয়োগকারী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, যা পুঁজিবাজারের উন্নয়নের পরিপন্থী। শেয়ার কারসাজির কারণে সিকিউরিটিজ আইন লঙ্ঘন প্রমাণিত হওয়ায় বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন আবুল খায়ের ও তার সহযোগীদের বিভিন্ন সময়ে অর্থদণ্ডে দণ্ডিত করেছে।
চিঠিতে আরো উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন আবুল খায়ের ও তার সহযোগীদের বিভিন্ন সময়ে যে অর্থদণ্ডে দণ্ডিত করেছে, তা তুলে ধরা হলো—২০২২ সালের ১৯ জুন গ্রিন ডেল্টা ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার কারসাজির জন্য আবুল খায়েরের স্ত্রী কাজী সাদিয়া হাসান ও তাদের সহযোগীদের ৪২ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। ২০২২ সালের ১৯ জুন ঢাকা ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার কারসাজির জন্য আবুল খায়েরের স্ত্রী কাজী সাদিয়া হাসান ও তাদের সহযোগীদের ৯৫ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। ২০২২ সালের ১৯ জুন এশিয়া ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার কারসাজির জন্য আবুল খায়েরের দেশ আইডিয়াল ট্রাস্ট কো-অপারেটিভকে ৭২ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। ২০২২ সালের ৬ জুলাই ফরচুন সুজের শেয়ার কারসাজির জন্য আবুল খায়েরের বাবা আবুল কালাম মাতবর এবং তার সহযোগীদের ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। ২০২২ সালের ৬ জুলাই এনআরবিসি ব্যাংকের শেয়ার কারসাজির জন্য আবুল খায়েরের বোন কনিকা আফরোজ এবং তার সহযোগীদের ৩ কোটি ৭৫ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।
২০২২ সালের ২ আগস্ট ওয়ান ব্যাংকের শেয়ার কারসাজির জন্য আবুল খায়েরের বাবা আবুল কালাম মাতবর এবং তার সহযোগীদের ৩ কোটি টাকা জরিমানা করা হয়েছে। ২০২২ সালের ২ আগস্ট বিডিকম অনলাইনের শেয়ার কারসাজির জন্য আবুল খায়েরের প্রতিষ্ঠান ডিআইটি কো-অপারেটিভ এবং তার সহযোগীদের ৫৫ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। ২০২২ সালের ৩০ অক্টোবর আইপিডিসি ফাইন্যান্সের শেয়ার কারসাজির জন্য আবুল খায়ের এবং তার সহযোগীদের ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। ২০২২ সালের ২৮ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার কারসাজির জন্য আবুল খায়েরের স্ত্রী কাজী সাদিয়া হাসানকে ১ কোটি ৪০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। ২০২২ সালের ২৮ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার কারসাজির জন্য আবুল খায়েরের প্রতিষ্ঠান ডিআইটি কো-অপারেটিভকে ৩৫ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।
২০২৪ সালের ২১ মার্চ জেনেক্স ইনফোসিসের শেয়ার কারসাজির জন্য আবুল খায়ের এবং তার সহযোগীদের ২০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। সর্বশেষ ২০২৪ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর প্যারামাউন্ট ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার কারসাজির জন্যআবুল খায়ের এবং তার সহযোগীদের ২৫ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে।
প্রসঙ্গত, প্যারামাউন্ট ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার কারসাজির জন্য আবুল খায়েরের ব্যবসায়িক পার্টনার বিশ্বখ্যাত ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানকে ৫০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে।
উল্লেখ, ২০১৯ সালের নভেম্বরে প্যারামাউন্ট ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার কারসাজির মাধ্যমে আলোচনায় আসেন আবুল খায়ের হিরু। প্যারামাউন্টের হাত ধরেই অন্যান্য ইন্স্যুরেন্সের কারসাজিতে নামেন তিনি। পরবর্তীতে ইন্স্যুরেন্সের পাশাপাশি অন্যান্য কোম্পানির শেয়ার নিয়েও তিনি কারসাজি করেন। হিরু নিজে এবং পাশাপাশি পরিবারের সদস্যদ ও অন্য সহযোগীদের নিয়ে গড়ে তোলেন বিশাল সিন্ডিকেট। তার সিন্ডিকেটে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে আছেন: স্ত্রী কাজী সাদিয়া হাসান, বাবা আবুল কালাম মাতবর, মা আলেয়া বেগম, বোন কনিকা আফরোজ, ভাই মোহাম্মদ বাসার ও সাজিদ মাতবর এবং স্ত্রী সাদিয়া হাসানের ভাই কাজী ফুয়াদ হাসান ও কাজী ফরিদ হাসান।
হিরুর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহনে মন্ত্রণালয়ে কোনো চিঠি পাঠানো হয়েছে কি না জানতে চাইলে বিএসইসির মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ রেজাউল করিম জানান, ‘শেয়ার কারসাজির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় হিরুকে একাধিকবার জরিমানা করা হয়েছে। তবে, মন্ত্রণালয়ে কোনো চিঠি পাঠানো হয়েছে কি না, সে বিষয়ে আমি অবগত।’