চারকোল রপ্তানি মৌসুমে শঙ্কায় ব্যবসায়ীরা, একক নিয়ন্ত্রণে সাবেক মন্ত্রী মির্জা আজমের সিন্ডিকেট
নিজস্ব প্রতিবেদক : আগামী তিন-চার মাস বিশ্ববাজারে পাটখড়ি থেকে উৎপাদিত চারকোলের রফতানির ভরা মৌসুম। সাবেক প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজমের ভাই শিপনের একক সিন্ডিকেটে রফতানি নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার রফতানি ব্যাহতের আশঙ্কা করছেন রফতানিকারকরা।
স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর এফবিসিসিআই, ডিসিসিআই, বিজিএমইএ, বিকেএমইএসহ প্রায় সব বাণিজ্য সংগঠন থেকে আওয়ামী লীগপন্থিরা সরে গেলেও চারকোল রফতানিকারক অ্যাসোসিয়েশনে (বিসিসিএমইএ) এখনো সে স্বৈরশাসকের সিন্ডিকেটই বিদ্যমান।
চারকোল রফতানিতে নিয়োজিত ট্রেডবডি বাংলাদেশ চারকোল উৎপাদনকারী ও রফতানিকারক সমিতি (বিসিসিএমইএ) সভাপতি হিসেবে দায়িত্বে রয়েছেন সাবেক পাট ও বস্ত্র প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজমের সহোদর মির্জা জিল্লুর রহমান শিপন।
জানা গেছে, বাংলাদেশ থেকে চারকোলের প্রধান আমদানিকারক দেশ চীন। এ ছাড়া তাইওয়ান, ব্রাজিল, মেক্সিকো, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, জাপান, তুরস্ক, দক্ষিণ কোরিয়া, জার্মানিসহ ইউরোপের দেশগুলোতে চারকোলের বাজার রয়েছে।
বর্তমানে ফরিদপুর, রাজবাড়ি, মাগুরাসহ কয়েকটি জেলার প্রায় ৪০টি কারখানায় চারকোল উৎপাদিত হচ্ছে। এসব কারখানা থেকে বছরে প্রায় ১০ হাজার মেট্রিক টন চারকোল বিদেশে রফতানি হয়। ব্যবসায়ীরা এ খাতকে বৈষম্যমুক্ত করতে ও রফতানি আয় বাড়াতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয় বরাবর স্মারকলিপি দিয়েছে।
স্মারকলিপিতে ব্যবসায়ীরা বলেন, সারাদেশে মির্জা শিপনের নিজস্ব লোকদের দিয়ে একচেটিয়া ফ্যাক্টরি ও বাজার নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে। চাইনিজ ফ্যাক্টরি মালিক ও বায়ারদের বাংলাদেশ থেকে সরিয়ে দেয়ার সব আয়োজন সম্পন্ন করেছেন তিনি। নিজের পছন্দের ব্যবসায়ীদের দিয়ে সেসব ফ্যাক্টরির মালিকানায় বসিয়েছেন। পুরাতন ও অভিজ্ঞ বায়ারদের পাশ কাটিয়ে বাজার সিন্ডিকেট করার জন্য একটি নির্দিষ্ট বায়ারের হাতে চারকোল তুলে দেয়ার জন্য অ্যসোসিয়েশনকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছেন।
নাম প্রকাশ অনিচ্ছুক একজন রফতানিকারক বলেন, বিশ্ববাজারে চারকোল রফতানির বিশাল মার্কেট রয়েছে। সরকার এখন রফতানি আয় বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ নিচ্ছে। অথচ সাবেক মন্ত্রীর ভাই তার একক সিন্ডিকেটের বাহিরে কোনো ব্যবসায়ীকে ভিড়তে দিচ্ছে না। ফলে কারখানা সচল রাখা নিয়ে শঙ্কায় পড়েছেন ব্যবসায়ীরা।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, ফরিদপুর, মাগুরা ও মাদারীপুর এলাকায় বিভিন্ন চারকোল ফ্যাক্টরির মালিকরা সিন্ডিকেটের কারণে পাটকাঠির উচ্চ দামের ফলে এখনো ঠিকঠাক উৎপাদনে যেতে পারেনি। ফ্যাক্টরি মালিকদের অভিযোগ, একটা গোষ্ঠী সিন্ডিকেট করে রাখার কারণে এ সিজনে পাটকাঠি কিনতে হচ্ছে ৩৫০-৩৭০টাকা দামে। অথচ এখন এ পাটকাঠির সিজনে আমরা গতবারও কাঁচামাল কিনেছি ২০০-২২০ টাকা দরে। ফ্যাক্টরি মালিকদের মতে, এবার কোনোভাবেই বায়ার ঠকানো সম্ভব হবে না আর।
তাদের অভিযোগ, মাঠে কাঁচামালের জোগান থাকা সত্ত্বেও পাটকাঠি ব্যাপারীদের সঙ্গে যোগসাজশ করে অ্যাসোসিয়েশন সভাপতি মির্জা শিপন ও তার একান্তই নিজস্ব ৩-৪ জনের একটা সিন্ডিকেট পুরো ফরিদপুর অঞ্চলের পাটকাঠি ব্যাপারীদের জিম্মি করে চারকল উৎপাদনে নিয়ন্ত্রণ নিয়ে চায়নার একটা নির্দিষ্ট বায়ারকে সুবিধা দিতে মরিয়া হয়ে কাজ করছে।
চারকোল ব্যবসায়ীরা জানান, বিগত ৭-৮ মাস ধরেই চায়নার একটা বায়ার-গোষ্ঠীর সঙ্গে বাংলাদেশের চারকোল অ্যাসোসিয়েশনকে ব্যবহার করে আওয়ামী লীগ নেতা ও অ্যাসোসিয়েশনের বর্তমান সভাপতি মির্জা জিল্লুর রহমান (শিপন) তার পছন্দের ১০টা কোম্পানি দিয়ে উক্ত বায়ারের সঙ্গে চুক্তি করে বাংলাদেশের বাকি ফ্যাক্টরি মালিক ও রফতানিকারকদের কোণঠাসা করতেই বর্তমান এ ভরা উৎপাদনের মৌসুমে পাটকাঠির ব্যাপারীদের জিম্মি করতেই এ অচলাবস্থা সৃষ্টি করা হয়েছে, যার ফলে পুরো চারকোল বাজার চলে যাচ্ছে একটা সিন্ডিকেটের হাতে।
জানা গেছে, মির্জা জিল্লুর রহমান শিপন কমিশন বাণিজ্যের মাধ্যমে দেশের রফতানিকারকদের কম দামে পণ্য রফতানি করতে বাধ্য করতেন।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতি বছর জুলাই মাস থেকে বাজারে পাটকাঠি ওঠা শুরু হয়। সে হিসেবে অক্টোবর মাস থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত উৎপাদনে থাকে কারখানা। সে হিসেবে এখন মৌসুমের চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। কিন্তু নানা জটিলতায় রফতানিকারকরা উদ্বেগে রয়েছেন।
দেশে বছরে ৩২-৩৫ লাখ টন পাটখড়ি উৎপাদিত হয়। এসব পাটখড়ির মাত্র ৬০ শতাংশ যদি ছাইয়ে রূপান্তর করা সম্ভব হয় তাহলে বছরে ছাই উৎপাদন হবে প্রায় সাড়ে ৪ লাখ টন। এক টন ছাইয়ের দাম প্রায় ৯০০-১১০০ ডলার। ফলে চারকোল রফানি করে বছরে ৪০ থেকে ৫০ কোটি ডলার বা প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি আয় করা সম্ভব। এ ছাড়া ২০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান করানো যাবে।
বিসিসিএইএ সভাপতি মির্জা জিল্লুর রহমান শিপনকে একাধিকবার ফোন কল করলেও তাকে পাওয়া যায়নি।
শেয়ারবাজার নিউজ ডটকম /কে.এইচ