পাশে ছিল না মিত্ররা-মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে সেনাবাহিনী, এসবেই কি আসাদ সরকারের পতন?
আন্তর্জাতিক ডেস্ক: ২৩ বছর বয়সী সিরিয়ান সেনা সদস্য ফারহান আল খাউলিকে খুবই কম বেতন দেয়া হতো, যা তাকে হতাশ করেছে। তার দলটি বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত শহরের কাছেই ইদলিবে দায়িত্ব পালন করে। যেখানে প্রয়োজন ছিল ৯ জন সৈন্যের সেখানে ছিল মাত্র তিনজন। পরে এদের মধ্য থেকে কমান্ডিং অফিসারকে ঘুষ দিয়ে একজন পালিয়ে যায়। বাকী দুজনের মধ্যে এজন মানসিকভাবে ফিট ছিল না।
সিরিয়াতে দীর্ঘ সময় ধরে চলা গৃহযুদ্ধ বন্ধ হওয়ার পর গত কয়েক বছর ধরে ইসলামপন্থী বিদ্রোহী গোষ্ঠী হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস) দেশটিতে ফ্রন্ট লাইনে চলে আসে। এ অবস্থার মধ্যে গত বুধবার (২৭ নভেম্বর) খাউলির কমান্ডিং অফিসার তাকে ফোন দিয়ে জানায় বিদ্রোহী গোষ্ঠীরা তার অঞ্চলের দিকে যাচ্ছে। এজন্য তাকে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য ইউনিট প্রস্তুত রাখার নির্দেশ দেন।
পরবর্তীতে খাউলি তার ফোনটি এয়ারপ্লেন মুডে রেখে সামরিক পোশাক খুলে সাধারণ মানুষের বেশ ধরে অস্ত্র ফেলে ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যায়। তিনি যখন দক্ষিণের রাস্তা ধরে হাঁটছিলেন তখন দেখলেন সেনাবাহিনীর অন্যান্য গ্রুপের সদস্যরা পালিয়ে যাচ্ছে।
খাউলি দামেস্কে ঘোড়ার একটি আস্তাবলে কাজ নিয়েছেন। সেখানে বসেই বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে জানায়, “আমি যখন পেছনে ফিরে তাকাই তখন দেখলাম প্রত্যেকেই তার পেছনে হাঁটছে। তাদের মধ্যে যখন একজন পালিয়ে যাচ্ছে তখন প্রত্যেক সৈন্য তাদের অস্ত্র ফেলে দ্রুতই ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যায়।”
এ ঘটনার দুই সপ্তাহ কম সময়ের মধ্যে বিদ্রোহীরা রাজধানী দামেস্কের দিকে অগ্রসর হয়। কারণ সাবেক প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ ও তার সেনাবাহিনী মানসিকভাবেই ভেঙে পড়ে। আর এটিই সিরিয়াতে চলা দীর্ঘ ১৩ বছরের সংঘাতের অবসান ঘটিয়েছে। ওই সময়ে দেশটিতে কয়েক হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়।
আসাদ সরকারের পতনের কারণ নিয়ে একাধিক সূত্রের সঙ্গে কথা বলেছে রয়টার্স। যার মধ্যে রয়েছে- সিরিয়ান সেনাবাহিনীর দুটি সূত্র, তিনজন সিনিয়র সিরিয়ান অফিসার, দুজন ইরাকি মিলিশিয়া কমান্ডার, যারা সিরিয়ান সেনাবাহিনীর সঙ্গে কাজ করেছে। এছাড়া রয়েছে সিরিয়ান নিরাপত্তা সূত্র এবং লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহ ও আসাদের প্রধান সামরিক মিত্র।
সূত্রের কাছ থেকে পাওয়া এবং রাজধানী দামেস্কের একটি পরিত্যক্ত সামরিক অফিস থেকে রয়টার্সের পাওয়া গোয়েন্দা নথিতে দেখা গেছে, আসাদ বাহিনী কতটা ভয়ে ছিল এবং তাদের মানসিক বিপর্যয় কীভাবে ঘটেছে। এছাড়া ওই নথিতে আসাদ বাহিনীর অতিরিক্ত বিদেশি মিত্রদের ওপর নির্ভরতা এবং দুর্নীতির বিষয়টি উঠে এসেছে।
অধিকাংশ সূত্র নাম না প্রকাশের শর্তে কথা বলেছেন। কারণ মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলার জন্য তাদের অনুমতি নেই বা তারা ভয়ে আসেন। ২০১১ সালে সিরিয়াতে যখন গৃহযুদ্ধ শুরু হয় তখন আসাদ বাহিনীর কমান্ড ইরানের মিত্রদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। ফলে ইরান সিরিয়াতে লেবানিজ এবং ইরাকি ফোর্স পাঠায়। যার মাধ্যমে সিরিয়াতে সেরা ফাইটিং ইউনিট গঠন করা হয়। সিনিয়র সব সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে।
তারা আরও জানায়, সিরিয়ান সেনাবাহিনীর সামরিক অপারেশন কাঠামো ইরানিয়ান সামরিক উপদেষ্টাদের দ্বারা পরিচালিত হত এবং এ কাজে তাদের মিত্র বাহিনী কাজ করত।
ইরানের সামরিক উপদেষ্টাদের সঙ্গে কাজ করা ইরাকি মিলিশিয়া কমান্ডারের একজন জানিয়েছেন, দামেস্কে যখন ইসরায়েলি হামলা শুরু হয় তখন ইরানের সামরিক উপদেষ্টা তাদের দেশে চলে যায়। অন্যরাও গত সপ্তাহে চলে যায়।
হিজবুল্লাহর সঙ্গে সম্পৃক্ত একটি সূত্র জানিয়েছে, গত অক্টোবরে ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধে জড়ালে লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহ সিরিয়া ছেড়ে লেবাননে চলে যায় এবং সেখানে তারা তেল আবিবের সঙ্গে যুদ্ধে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। এর ফলে সিরিয়ার সেনাবাহিনীর নিজস্ব কেন্দ্রীয় কমান্ড তেমন সক্রিয়ভাবে কাজ করতে পারেনি। ফলে দ্রুত সময়ের মধ্যেই সিরিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর আলেপ্প দখলে নেয় বিদ্রোহীরা।