কারসাজিতে কোনো কৌশল বাদ রাখেনি ন্যাশনাল ফিড
নিজস্ব প্রতিবেদক : জালিয়াতিতে সর্বেসর্বা পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ন্যাশনাল ফিড লিমিটেড। কারসাজির কোনো কৌশলই যেন বাদ রাখেনি কোম্পানিটি। শ্রমিকদের জন্য গঠন করা ওয়ার্কার্স প্রফিট পার্টিসিপেশন ফান্ডে (ডব্লিউপিপিএফ) কোনো অর্থ জমা তো করেইনি, উল্টো ঋণের বিপরীতে সুদ দেওয়ার ব্যাপারেও জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছে। আর্থিক হিসাবে দীর্ঘমেয়াদি ও স্বল্পমেয়াদি ঋণের যে তথ্য দেওয়া হয়েছে, জালিয়াতি করা হয়েছে সেখানেও। ভুয়া সম্পত্তি দেখানোসহ কোম্পানিটির নানা অনিয়ম ও জালিয়াতির তথ্য নিরীক্ষা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
নিরীক্ষা প্রতিবেদন অনুযায়ী, ন্যাশনাল ফিড ২৮ কোটি ৪০ লাখ টাকা সম্পদ, যন্ত্র এবং যন্ত্রাংশ বাবদ দেখালেও তারা সম্পদের রেজিস্ট্রার এবং হিসাবের বই দিতে পারেনি। ফলে এই পরিমাণ সম্পদ ও যন্ত্রের সত্যতা পাওয়া যায়নি। চলতি বছরের জুন পর্যন্ত সময়ে দেখিয়েছে—তারা পাওনা বাবদ পরিশোধ করেছে ২ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। কিন্তু এ টাকার সত্যতা নিশ্চিত হতে নিরীক্ষক তাদের কাছে প্রয়োজনীয় প্রমাণাদি চাইলে তারা তা দিতে পারেনি। ফলে এ পাওনা টাকার সত্যতা যাচাই করা সম্ভব হয়নি বা তারা মিথ্যা তথ্য দিয়েছে। কোম্পানিটি ৮৭ কোটি ১০ লাখ টাকা আর্থিক হিসাবে গ্রহণ করেছে মর্মে দেখিয়েছে। কিন্তু এই টাকার বিপরীতে কোনো ধরনের প্রভিশন করেনি। কোম্পানিটি ঋণ নিয়েও জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছে। তারা যে পরিমাণ ঋণের তথ্য দিয়েছে, তার কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি।
নিরীক্ষক জানিয়েছে, কোম্পানিটি দীর্ঘমেয়াদি ঋণ হিসেবে ৬৩ কোটি ৫১ লাখ টাকা আর্থিক প্রতিবেদনে দেখিয়েছে। যেখানে দীর্ঘমেয়াদি ঋণের অংশে ৩৭ কোটি ৬২ লাখ টাকা এবং বর্তমান অংশে ২৫ কোটি ৮৯ লাখ টাকা দেখিয়েছে। কিন্তু ব্যাংকের স্টেটমেন্ট অনুযায়ী এ ঋণের পরিমাণ ৬১ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। এখানে কোম্পানিটি ১ কোটি ৯৬ লাখ টাকা বাড়িয়ে দেখিয়েছে। এ তথ্য নিশ্চিত হতে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের কাছে সত্যতা জানতে চাইলেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
ন্যাশনাল ফিড শ্রমিকদের জন্য গঠিত ডব্লিউপিপিএফের অর্থ নিয়েও জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছে। তথ্য অনুযায়ী, কোম্পানিটি দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে শ্রমিকদের লাভের অংশের ২ কোটি ৪৮ লাখ টাকা পরিশোধ না করে তাদের পকেটে রেখেছে। ফলে কয়েক বছর ধরে শ্রমিকরা তাদের প্রাপ্য পাওনা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এ ছাড়া এই ফান্ডের ব্যাপারে কোনো প্রকার অডিট রিপোর্টও পায়নি নিরীক্ষক।
ঋণের বিপরীতে দেওয়া সুদের ব্যাপারেও জালিয়াতি করেছে ন্যাশনাল ফিড। কোম্পানিটি ৬ কোটি ৭ লাখ টাকা দীর্ঘমেয়াদি ঋণের বিপরীতে সুদ হিসেবে ব্যয় দেখিয়েছে। কিন্তু ঋণ প্রতিবেদন থেকে নিরীক্ষক ৪ কোটি ১১ লাখ টাকার তথ্য পেয়েছে। এখানে সুদ হিসেবে ১ কোটি ৯৬ লাখ টাকা বেশি দেখিয়েছে। এর মাধ্যমে কোম্পানি কর্তৃপক্ষ মুনাফার ওপর প্রভাব ফেলতে জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছে।
সরকারি বন্ডে বিনিয়োগের নামেও মিথ্যা তথ্য দিয়েছে কোম্পানিটি। আর্থিক প্রতিবেদনের একটি অংশে কোম্পানি জানায়, সাধারণ সংরক্ষণ হিসাবে সরকারি বন্ডে বিনিয়োগে ৬১ লাখ ৯০ হাজার টাকা রাখা হয়েছে। কিন্তু এর বিপরীতে কোনো প্রমাণ দিতে পারেনি তারা। অর্থাৎ এখানেও জালিয়াতি করেছে ন্যাশনাল ফিড। জালিয়াতি হয়েছে মজুত পণ্য নিয়েও। কোম্পানিটি মজুত পণ্য হিসেবে ৫৬ কোটি ৫৯ লাখ টাকা দেখিয়েছে। কিন্তু এই পণ্যের কোনো তালিকা তারা দিতে পারেনি। শুধু মজুত পণ্যের সার্টিফিকেট পেয়েছে নিরীক্ষক।
নিরীক্ষক বলছে, ন্যাশনাল ফিড কোম্পানি অন্য দুটি কোম্পানিকে কোনো ধরনের ব্যবসায়িক বিবেচনা ছাড়াই ২ কোটি ৫০ লাখ টাকা অগ্রিম হিসেবে দিয়ে দিয়েছে। এর মধ্যে কার্নপুর অ্যাগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডকে ১ কোটি ৩২ লাখ এবং ন্যাশনাল হ্যাচারি লিমিটেডকে ১ কোটি ১৮ লাখ টাকা অগ্রিম প্রদান করেছে।
এ বিষয়ে জানতে ন্যাশনাল ফিড মিল লিমিটেডের কোম্পানি সচিবকে ফোন দিলে তিনি এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
২০১৫ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিটির অনুমোদিত মূলধন ২০০ কোটি টাকা; পরিশোধিত মূলধন ৯৩ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। কোম্পানিটির মোট শেয়ার সংখ্যা ৯ কোটি ৩৩ লাখ ৬১ হাজার ৩২৪টি। এরমধ্যে উদ্যোক্তা পরিচালকদের হাতে রয়েছে ৩০ দশমিক ৪০ শতাংশ, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের হাতে রয়েছে ৬ দশমিক ১৪ শতাংশ, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে শূন্য দশমিক ১১ শতাংশ এবং বাকি ৬৩ দশমিক ৩৫ শতাংশ রয়েছে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে। বর্তমানে কোম্পানিটির শেয়ার ‘জেড’ ক্যাটাগরিতে লেনদেন হচ্ছে।
ন্যাশনাল ফিড মিল ২০১৯ সালে শেয়ার প্রতি মুনাফা করেছে ১৫ পয়সা, সে বছর বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ দিয়েছে ১ শতাংশ বোনাস শেয়ার। ২০২০ সালে কোম্পানিটির শেয়ার প্রতি মুনাফা হয়েছে ১৭ পয়সা, সে বছর ২ শতাংশ নগদ এবং ৮ শতাংশ বোনাস লভ্যাংশ দিয়েছে। ২০২১ সালে শেয়ার প্রতি মুনাফা করেছে ১৮ পয়সা, সে বছর বিনিয়োগকারীদের ১ শতাংশ বোনাস লভ্যাংশ দিয়েছে। ২০২২ সালে শেয়ার প্রতি মুনাফা করেছে ৮ পয়সা, সে বছর বিনিয়োগকারীদের ১ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দিয়েছে। এরপর ২০২৩-২৪ সালে বিনিয়োগকারীদের কোনো লভ্যাংশ দেয়নি কোম্পানিটি। ফলে কোম্পানিটিকে শাস্তি হিসেবে ‘জেড’ ক্যাটেগরিতে স্থানান্তর করেছে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই)। সর্বশেষ বৃহস্পতিবার কোম্পানিটির শেয়ার ৭ টাকা ৯০ পয়সায় লেনদেন হয়েছে, যা অভিহিত মূল্যের নিচে।