আজ: মঙ্গলবার, ০৭ জানুয়ারী ২০২৫ইং, ২৩শে পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৫ই রজব, ১৪৪৬ হিজরি

সর্বশেষ আপডেট:

০৫ জানুয়ারী ২০২৫, রবিবার |

kidarkar

বোরাক রিয়েল এস্টেটের আইপিও আবেদন বাতিল

নিজস্ব প্রতিবেদক : পুঁজিবাজার থেকে ৪০০ কোটি টাকা সংগ্রহের জন্য আবেদন করা বোরাক রিয়েল এস্টেট লিমিটেডের প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) আবেদন বাতিল করেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।

আইপিওর আবেদনের সঙ্গে দেওয়া কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদনে নানা অসঙ্গতি পরিলক্ষিত হওয়ায় বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ‌্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (পাবলিক ইস‌্যু) রুলস, ২০১৫ এর রুল ১৫(৫) এর ক্ষমতা বলে কমিশন কোম্পানির আইপিও আবেদন বাতিল করেছে।

সম্প্রতি বোরাক রিয়েল এস্টেট লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে (সিইও) এ সংক্রান্ত একটি চিঠি দেওয়া হয়েছে বলে বিএসইসি সত্রে জানা গেছে।

একইসঙ্গে বিষয়টি কোম্পানির আইপিওর দায়িত্বে নিয়োজিত ইস্যু ম্যানেজার বিএমএসএল ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড ও স্বদেশ ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের ব‌্যবস্থাপনা পরিচালককে বিষয়টি অবহিত করা হয়েছে।

বিভিন্ন সময়ে দেওয়া কোম্পানির আইপিও আবেদন, খসড়া প্রসপেক্টাস, তথ্য, সংবেদনশীল তথ্য, ডিএসইর পর্যবেক্ষণ এবং অন্যান্য প্রাসঙ্গিক নথি ও ব্যাখ্যা যাচাই করে বেশকিছু অসঙ্গতি পাওয়া গেছে বলে চিঠিতে জানিয়েছে বিএসইসি।

জানা গেছে, কোম্পানিটি আবাসনে তার বিনিয়োগের সম্পদের মূল্য জানিয়েছে ৭০০ কোটি ২০ লাখ টাকা। সেই সাথে ৩০ জুন ২০২৩ শেষে কর পরবর্তী মুনাফা হয়েছে ৬৫২ কোটি ৪৯ লাখ টাকা। কিন্তু ইন্টারন‌্যাশনাল অ‌্যাকাউন্টিং স্ট‌্যান্ডার্ড (আইএএস) অনুযায়ী, আবাসনে বিনিয়োগ করলে কাজ শেষ হওয়ার পর থেকে সেই বিনিয়োগের লাভ বা লোকসান হিসাব করতে হবে। তবে ৭০০ কোটি ২০ লাখ টাকায় যে মুনাফা দেখানো‌ হয়েছে তা অবাস্তব প্রমাণ করে।

নিট সম্পদ মূল্যের বিষয়ে বলা হয়েছে, কোম্পানির সম্পদ মূল্য ২০২২ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত ছিল ৮১.৩৭ টাকা। যা ২০২৩ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৪৮.৫৪ টাকা। অথচ ন্যায্যমূল্য ও আসল মূল্যের লাভ বাদ দিলে সম্পদ মূল্য হতো ৮৫.২০ টাকা। তাই এ অতিমূল্যায়িত নিট সম্পদ মূল্যের বিষয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। সেই সাথে এই মূল্যে কোম্পানি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হলে বিনিয়োগকারী ক্ষতিগ্রস্ত হবেন এবং কোম্পানি তাদের আর্থিক অবস্থান ভুলভাবে উপস্থাপন করেছে।

লভ্যাংশের বিষয়ে বলা হয়েছে, কোম্পানিটি ২০২৩ সালের ৩০ জুন শেষে আনরিয়ালাইজড মুনাফা কৃত্রিমভাবে বাড়িয়ে দেখিয়েছে। ফলে গুরুত্বপূর্ণভাবে প্রকৃত নগদ অর্থ প্রবাহ না থাকায় লভ্যাংশ দিতে পারবে না। তাই লভ্যাংশ দিতে গেলে কোম্পানির এই অবাস্তব মুনাফা দেখানো ছাড়া কোনো উপায় থাকবে না।

আয়ের বা ইপিএস অসঙ্গতির বিষয়ে বলা হয়েছে, ২০২২ সালের ৩০ জুন কোম্পানির শেয়ারপ্রতি মুনাফা (ইপিএস) ছিল ২.৯৯ টাকা। যা ২০২৩ সালের ৩০ জুন শেষে দেখানো হয়েছে ৬৫.২৫ টাকা। ৭০০ কোটি ২০ লাখ টাকা বাদ দিলে তা হবে মাত্র ৪.৬৪ টাকা। যা কোম্পানি অসত্য তথ্য প্রদান করেছে এবং তালিকাভুক্তির পর বিনিয়োগকারীদের ক্ষতি করবে।

এছাড়া কোম্পানি ২০২৩ সালের ৩০ জুন যে আর্থিক তথ্য প্রদান করেছে তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে এবং কোম্পানি অসত উদ্দেশ্যও থাকতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।

মো. নূর আলী বোরাক রিয়েল এস্টেট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হয়েও ডিএসইতে তালিকাভুক্ত ইউনিক হোটেল অ্যান্ড রিসোর্টস এবং অন্যান্য অতালিকাভুক্ত ৮ কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক। ফলে তিনি তালিকাভুক্ত কোম্পানির আইন লঙ্ঘন করেছে।

সিভিল এভিয়েশন অথরিটি অফ বাংলাদেশের অনুমোদন না পাওয়ায় বনানী ডিএনসিসি ইউনিক কমপ্লেক্স বা শেরাটন হোটেলের ২১ থেকে ২৪তম তলার কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। যা কোম্পানির আয়ের ওপর একটি উল্লেখযোগ্য নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। কোম্পানি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হলে এই ঘাটতি শেষ পর্যন্ত বিশেষ করে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের স্বার্থকে ক্ষুণ্ন করতে পারে।

এছাড়া আরো জানা গেছে, কোম্পানিটি কারওয়ান বাজারে অবস্থিত একটি ১৩ তলা বিশিষ্ট বোরাক জহির টাওয়ার নির্মাণের জন্য রাজউক থেকে অনুমোদন পেয়েছে। অথচ প্রতিবেদনে বিল্ডিংটিকে ২০ তলা হিসেবে দেখানো হয়েছে। যা অনুমোদন এখনো বাকি আছে। সেই সাথে ইস্যুকারীকে দুটি হোটেল প্রকল্পের বিনিয়োগের সম্ভাব্য মূল্যায়ন প্রদান করতে হবে। এর মধ্যে ঢাকায় সাউথ পার্ক সেভেন স্টার হোটেল নির্মাণ, যার জন্য কোম্পানি ৪০০ কোটি টাকা থেকে ২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করতে চায়। ইউনিক অ্যাক্রোপলিস নির্মাণে ১০০ কোটি টাকা ব্যয় করার কথা বলা হয়েছে। এজন্য বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এর মতো একটি স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান দ্বারা ব্যাপক ব্যয়-সুবিধা বিশ্লেষণ পরিচালনা করার কথা বলা হয়েছে। যেখানে তহবিলের টাকা ব্যবহার করে এই ধরনের বিনিয়োগের সমালোচনা করা হয়েছে।

আর কোম্পানি হোটেল প্রকল্পগুলোর সম্ভাব্য মূল্যায়ন জমা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। যার ফলে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন আইপিওর বিষয়ে সাথে অসম্মতি জানিয়েছে।

কোম্পানির আইপিওর ১৫ শতাংশ শেয়ার কর্মচারীদের বরাদ্দ দেওয়ার কথা জানালেও তাদের বিও নম্বারসহ প্রয়োজনীয় তথ্য জমা দেয়নি, যা আইনের অসঙ্গতি।

সেই সাথে কোম্পানি গুলশানের প্রকল্প সাউথ পার্কের ৩৯.৪৫ শতক ভূমি পুনঃমূল্যায়ন করে এর মূল্য ৬১.৩১ কোটি থাকে ২২৪.৭০ কোটি বাড়িয়ে ২৮৬.০১ কোটি টাকা দেখিয়েছে। যেখানে কোম্পানি এটাকে বিনিয়োগ সম্পত্তি হিসেবে দেখালেও ভবিষ্যতে অন্যপক্ষের কাছে এই জমি বিক্রি বা ভাড়া দেওয়ার সুযোগ নেই। সুতরাং পুনঃমূল্যায়নের আয় বিবরণীতে দেখানো উচিত হয়নি। আর এর প্রভাব কাট-অফ প্রাইস নির্ধারণের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

অন্যদিকে, বোরাক রিয়েল এস্টেট লিমিটেডের সম্পত্তি, প্ল্যান্ট এবং সরঞ্জামগুলো বর্তমানে বিভিন্ন ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছে বন্ধক রাখা হয়েছে। যার মাধ্যমে ব্যাংক এবং এনবিএফআইগুলোর কাছ থেকে ঋণ এবং ধার নেওয়া হয়েছে। একইভাবে, কোম্পানির বিনিয়োগ সম্পত্তিও একই উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে বন্ধক রাখা হয়েছে। এদিকে ইউনিক হোটেল অ্যান্ড রিসোর্টসের কাছে বোরাক রিয়েল এস্টেট লিমিটেডের যে শেয়ারগুলো আছে তা ব্যাংক এবং এনবিএফআই থেকে ঋণ এবং ধার নেওয়ার জন্য বিভিন্ন ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সাথে জামানত হিসাবে বন্ধক রয়েছে। একইভাবে, ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেডের শেয়ার প্রাইম ব্যাংক লিমিটেড এবং ইউসিবি লিমিটেডের কাছে ঋণের জামানত হিসেবে বন্ধক রয়েছে।

এই পরিস্থিতিতে কোম্পানির সম্পত্তি, শেয়ার এবং ইনভেন্টরি বন্ধক, বা জামানত রয়েছে, যা উল্লেখযোগ্যভাবে খেলাপির ঝুঁকি বাড়ায়। আর ঋণ খেলাপি হলে, ব্যাংক এবং নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠান (এনবিএফআই) ঋণ পুনরুদ্ধারের জন্য এই সম্পদগুলো জব্দ করার অধিকার রাখে, যা কোম্পানির কার্যক্রমকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করতে পারে। ফলে কোম্পানির আর্থিক অবস্থার একটি বিভ্রান্তিকর চিত্র উপস্থাপন হতে পারে।

তাই কোম্পানির সার্বিক অসঙ্গতিগুলোর কথা বিবেচনা করে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ‌্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (পাবলিক ইস‌্যু) রুলস, ২০১৫ এর রুল ১৫(৫) এর ক্ষমতা বলে কমিশন কোম্পানির ৪০০ কোটি টাকার আইপিও আবেদন প্রত্যাখ্যান করেছে।

 

আপনার মতামত দিন

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.