বিনিয়োগকারীদের কাছে এখনো আস্থাহীন শেয়ারবাজার
খালিদ হাসান : ২০১০ সালে ধসের পনেরো বছর পরও বিনিয়োগকারীর কাছে এখনো আস্থাহীন দেশের শেয়ারবাজার। এখনো এটি পুঁজি হারানোর বাজার। ভালো-মন্দ বেশির ভাগ কোম্পানিতে বিনিয়োগ করেও লাভের দেখা মিলছে না। তাই বাজারে আসতে নতুন করে আগ্রহ তৈরি হচ্ছে না বিনিয়োগকারীদের মধ্যে।
গত ৫ই আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর ৮ আগস্ট দায়িত্ব নেওয়ার পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার অর্থ ও শেয়ারবাজারসহ সব খাতেই সংস্কারে হাত দেয়। এর অংশ হিসেবে সরকার বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনেও (বিএসইসি) সংস্কার কার্যক্রম শুরু করে। গত ১৮ জুলাই সাবেক ব্যাংকার খোন্দকার রাশেদ মাকসুদকে কমিশনের চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ দেয়। নিয়োগর পর আলোচনা- সমালোচনার মধ্যেই ৫ মাস অতিবাহিত হলেও কার্যকরী কোন উদ্যোগ নিতে দেখা যাচ্ছে না। নতুন যেসব উদ্যোগ নিয়েছে সেটা নিয়ে সমালোচনায়ই বেশি হয়েছে এবং বাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। ফলে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরছে না পুঁজিবাজারে।
সরকার বদলের পর সাময়িক সময়ের জন্য চাঙ্গা হয়ে উঠেছিল বাজার। ফলে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে কিছুটা স্বস্তি ফিরেছিল। আশা জাগিয়েছিলো শেয়ারবাজারে হয়তো গতি ফিরবে। কিন্তু কদিন যেতে না যেতেই শুরু হয় দরপতন। আর এই পতনেই চব্বিশ কেটেছে।
শুরু হয়েছে নতুন বছর আশা বুক বেধেছিলো বিনিয়োগকারীরা। নতুন বছরে হয়তো ঘুরে দাড়াবে শেয়ারবাজার। কিন্তু সেই আাশা শুধু আশায় রয়ে গেলো। নতুন বছর শুরু হয়েছে বিনিয়োগকারীদের পুঁজি হারানোর মধ্য দিয়ে। কিছুতেই যেন স্থিতিশীলতায় ফিরছে না শেয়ারবাজারে। কোন উদ্যোগেই দরপতনের বৃত্ত থেকে বের হতে পারছে না পুঁজিবাজার। দীর্ঘদিন থেকে ধৈর্য্য ধরে আস্থার প্রতিফল পাচ্ছেন না বিনিয়োগকারীরা।
এমনত অবস্থায় সংকট নিরসনে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ স্টক হোল্ডারদের সঙ্গে বৈঠকে বসার ঘোষনা দেন গতকাল। এরমধ্যে বৈঠকে নিয়ন্ত্রক সংস্থার চেয়ারম্যানকে সরানোর হতে পারে এমন খরবও ছড়িয়ে পড়ে। এমন খবরে ছড়িয়ে পড়তেই শেয়ারবাজারে বড় উত্থান হয়। আজ সকাল ১০ টায় বৈঠক শুরু হয়। ফলে সকাল থেকেই দেশের উভয় বাজারে বেশ চাঙ্গাভাব দেখা যায়।
কিন্তু বৈঠক শুরু হওয়ার পরেই অংশগ্রহণকারীরা বৈঠক চলাকালীন সময়েই বিভিন্ন মাধ্যমকে জানাতে থাকেন, বৈঠকে নিয়ন্ত্রক সংস্থার চেয়ারম্যানকে সরানোর এবং বাজারকে সাপোর্ট দেওয়ার বিষয়েও কোন কার্যকর সিদ্ধান্ত নেই। এমন খবরে বেলা ১টার পর চাঙ্গাবাজার পেছনে ছুঁটতে থাকে। যা লেনদেনের শেষ পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। এতে দেখা যায়, দিনশেষে ডিএসইর প্রধান সূচক যেখানে ৪৩ পয়েন্টের বেশি উত্থানে ছিল, সেখানে সূচক ৮ পয়েন্টের বেশি পতন হয়েছে। দিনের প্রথম ভাগে যেখানে ৮০ শতাংশ প্রতিষ্ঠানের দাম ঊর্ধ্বমুখী ছিল, সেখানে দিনশেষে উত্থান ও পতনের পরিমাণ সমানে সমান অবস্থান করছে।
বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, বর্তমান বাজার প্রেক্ষাপটে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরানো এবং বাজারে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনাই হয়ে উঠেছে বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ ২০২৪ সালে পুঁজিবাজারে যে আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে, তা কাটাতে হলে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার পাশাপাশি বিনিয়োগের সুরক্ষার নিশ্চয়তা দিতে হবে। এছাড়া সরকার পতনের পর পুঁজিবাজার উন্নয়নে নানামুখী সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
এসব সংস্কার যথাযথভাবে সম্পন্ন করা গেলে বাজারে ইতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। তবে পুঁজিবাজার ভালো করতে হলে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরানো সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। আস্থার সংকটের কারণে ২০২৪ সালজুড়ে পুঁজিবাজার পতনের মধ্যে ছিল। এখন বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে হলে বিনিয়োগের সুরক্ষা দিতে হবে। একই সঙ্গে বজায় থাকতে হবে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা।
বাজার বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সপ্তাহের তৃতীয় কার্যদিবস মঙ্গলবার (৭ জানুয়ারি) প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) লেনদেনের শুরুতে ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা দেখা গেলেও শেষ পর্যন্ত দরপতন হয়েছে। মূলত শেষ এক ঘণ্টায় এক শ্রেণির বিনিয়োগকারী বিক্রির চাপ বাড়ানোতে কিছু বড় মূলধনের প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের দাম কমে যায়। এতে মূল্যসূচকের পতন হয়েছে। তবে লেনদেনের পরিমাণ বেড়েছে। ডিএসইতে এদিন ১৩ কার্যদিবসের মধ্যে সর্বোচ্চ লেনদেন হয়েছে।
ডিএসইতে দাম কমার তালিকায় বেশি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিট থাকলেও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে (সিএসই) দাম বাড়ার তালিকায় বেশি প্রতিষ্ঠান স্থান পেয়েছে। ফলে এই শেয়ারবাজারে বেড়েছে মূল্যসূচক। তবে কমেছে লেনদেনের পরিমাণ।
এর আগে রোববার সপ্তাহের প্রথম কার্যদিবসে নেটওয়ার্ক সমস্যার কারণে ডিএসইতে লেনদেনে বিঘ্ন ঘটে। নির্ধারিত সময়ের দেড় ঘণ্টা পর সকাল ১১টা ৩০ মিনিটে লেনদেন শুরু হয়ে চলে দুপুর ২টা ৫০ মিনিট পর্যন্ত। পরের ১০ মিনিট অর্থাৎ ২টা ৫০ মিনিট থেকে ৩টা পর্যন্ত পোস্ট ক্লোজিং সেশন চলে। নেটওয়ার্ক সমস্যার সমাধানের পর লেনদেন হলেও শেয়ারবাজারে সার্বিক দরপতন হয়। পরের কার্যদিবস সোমবার ডিএসইতে মূল্যসূচকের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা দেখা যায়।
এমন পরিস্থিতিতে মঙ্গলবার ডিএসইতে লেনদেন শুরু হয় বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের দাম বাড়ার মধ্য দিয়ে। ফলে লেনদেনের শুরুতে সূচকের উর্ধ্বমুখী প্রবণতার দেখা মেলে। বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের দাম বাড়ায় লেনদেনের এক পর্যায়ে ডিএসই’র প্রধান মূল্যসূচক ৩৪ পয়েন্ট বেড়ে যায়।
লেনদেনের প্রথম তিন ঘণ্টা সূচকের ঊর্ধ্বমুখী ধারা অব্যাহত থাকে।
কিন্তু দুপুর ১টার পর শেয়ারবাজারের চিত্র বদলে যেতে থাকে। দাম বাড়ার তালিকা থেকে বেশ কিছু বড় মূলধনের প্রতিষ্ঠান দাম কামার তালিকায় চলে আসে। ফলে একদিনে দাম কমার তালিকা বড় হয়, অন্যদিকে সবকটি মূল্যসূচক কমে দিনের লেনদেন শেষ হয়।
লেনদেন শেষে ডিএসইতে দাম বাড়ার তালিকায় নাম লিখিয়েছে ১৬২টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিট। বিপরীতে দাম কমেছে ১৬৪টির। ৭৩টির দাম অপরিবর্তিত রয়েছে। এতে ডিএসই’র প্রধান মূল্যসূচক ডিএসইএক্স আগের দিনের তুলনায় ৮ পয়েন্ট কমে ৫ হাজার ১৯০ পয়েন্টে নেমে গেছে।
অন্য দুই সূচকের মধ্যে বাছাই করা ভালো ৩০টি কোম্পানি নিয়ে গঠিত ডিএসই-৩০ সূচক আগের দিনের তুলনায় ১০ পয়েন্ট কমে ১ হাজার ৯২২ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে। আর ডিএসই শরিয়াহ্ সূচক আগের দিনের তুলনায় ২ পয়েন্ট কমে ১ হাজার ১৫৮ পয়েন্টে অবস্থান করছে।
মূল্যসূচক কমলেও ডিএসইতে লেনদেনের পরিমাণ বেড়েছে। বাজারটিতে লেনদেন হয়েছে ৪২৭ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। আগের কার্যদিবসে লেনদেন হয় ৩৬২ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। সে হিসেবে আগের কার্যদিবসের তুলনায় লেনদেন বেড়েছে ৬৪ কোটি ৯১ লাখ টাকা। এর মাধ্যমে ১৭ ডিসেম্বরের পর ডিএসইতে সর্বোচ্চ লেনদেন হলো।
এই লেনদেনে সব থেকে বড় ভূমিকা রেখেছে মিডল্যান্ড ব্যাংকের শেয়ার। টাকার অঙ্কে কোম্পানিটির ২০ কোটি ১০ লাখ টাকার শেয়ার লেনদেন হয়েছে। দ্বিতীয় স্থানে থাকা খান ব্রাদার্স পিপি ওভেন ব্যাগের ১২ কোটি ৮২ টাকার শেয়ার লেনদেন হয়েছে। ১২ কোটি ৩৬ লাখ টাকার শেয়ার লেনদেনের ফলে তৃতীয় স্থানে রয়েছে ফাইন ফুডস।
এছাড়া ডিএসইতে লেনদেনের দিক থেকে শীর্ষ দশ প্রতিষ্ঠানের তালিকায় রয়েছে- রবি, ড্রাগন সোয়েটার, এশিয়াটিক ল্যাবরেটরিজ, পূবালী ব্যাংক, ওরিয়ন ইনফিউশন, বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন এবং ফারইস্ট নিটিং।
চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) সার্বিক মূল্যসূচক সিএএসপিআই বেড়েছে ৩৬ পয়েন্ট। বাজারটিতে লেনদেনে অংশ নেওয়া ২০৬টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১১৫টির দাম বেড়েছে। বিপরীতে দাম কমেছে ৬১টির এবং ৩০টির দাম অপরিবর্তিত রয়েছে। লেনদেন হয়েছে ৬ কোটি ৭৩ লাখ টাকা। আগের কার্যদিবসে লেনদেন হয় ৮ কোটি ৪৯ লাখ টাকা।
Kerbolb