আজ: বুধবার, ০৮ জানুয়ারী ২০২৫ইং, ২৪শে পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৭ই রজব, ১৪৪৬ হিজরি

সর্বশেষ আপডেট:

০৭ জানুয়ারী ২০২৫, মঙ্গলবার |

kidarkar

পুঁজিবাজারের উন্নয়ন ও বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে গোলটেবিল বৈঠকে যা বললেন বক্তারা

নিজস্ব প্রতিবেদক : পুঁজিবাজারের বর্তমান পরিস্থিতি এবং উন্নয়নের রোডম্যাপ নিয়ে স্টকহোল্ডারদের সাথে বৈঠক করেছেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। আজ (৭ জানুয়ারি ২০২৫ তারিখে) নিকুজ্ঞে ডিএসই টাওয়ারে এ গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়৷

গোলটেবিল বৈঠকে বাংলাদেশ সরকারের অর্থ ও বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের মাননীয় উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন৷ উল্লেখ্য যে, এই প্রথম সরকারের কোন অর্থমন্ত্রী বা অর্থ উপদেষ্টা ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে আসেন।

বৈঠকে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিএসইসি’র মাননীয় চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদ৷ গোলটেবিল বৈঠকের সভাপতিত্ব করেন ডিএসই’র চেয়ারম্যান মমিনুল ইসলাম৷ আরো উপস্থিত ছিলেন পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের কমিশনারবৃন্দ, বাংলাদেশ ব্যাংক, ন্যাশনাল বোর্ড অব রেভিনিউ, ফাইনান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিল, বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ, ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ, চট্রগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ, সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেড, ডিএসই ব্রোকারস এসোসিয়েশন, বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশন, অ্যাসোসিয়েশন অব অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিজ অ্যান্ড মিউচুয়াল ফান্ড এবং ভিআইপিবি অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি’র শীর্ষ পর্যায়ের প্রতিনিধিবৃন্দ।

বৈঠকের শুরুতেই ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান মমিনুল ইসলাম স্বাগত বক্তব্য ও পুঁজিবাজারের বর্তমান পরিস্থিতি ও উন্নয়নের রোডম্যাপ বিষয়ে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন৷ স্বাগত বক্তব্য ও মূল প্রবন্ধে তিনি বলেন, আজ ডিএসই’র জন্য একটি বিশেষ দিন, কারণ এই প্রথম কোন অর্থমন্ত্রী বা অর্থ উপদেষ্টা ডিএসইতে এসেছেন। আজকের আলোচনার মূল বিষয়বস্তু হলো পুঁজিবাজারকে কিভাবে বিনিয়োগকারীদের জন্য আকর্ষনীয় করা যায়। বিগত দিনে অদক্ষতা এবং দুর্নীতির কারণে আমাদের পুঁজিবাজার সংকুচিত হয়ে আছে এবং আমাদের অর্থনীতির জন্য সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারছে না। কিন্তু বর্তমান সরকার আসার পর নিয়ন্ত্রক সংস্থা, স্টক এক্সচেঞ্জ ও মার্কেট ইন্টারমিডিয়ারিজ একযোগে কাজ করছে। আমরা আশা করছি পুঁজিবাজার খুব শীঘ্রই তার সুফল ভোগ করবে।

তিনি আরও বলেন, বর্তমানে ডিএসই’র মার্কেটক্যাপের ৫৪% এখনও ইক্যুইটি। এখানে এখনও তালিকাভুক্ত কর্পোরেট বন্ড এবং মিউচ্যুয়াল ফান্ডের সংখ্যা অনেক কম। কর্পোরেট বন্ড ও মিউচ্যুয়াল ফান্ডের সংখ্যা বৃদ্ধি করা এখন একটি চ্যালেঞ্জের বিষয়। আমরা হয়তো নতুন প্রোডাক্টের দিকে যাব, কিন্তু মিউচ্যুয়াল ফান্ড এবং বন্ড মার্কেট যেহেতু তেমন কার্যকর হয়নি, সেহেতু নতুন প্রোডাক্টের দিকে এখনই নজর না দিয়ে এগুলোর উন্নয়নের জন্য আরও কাজ করা উচিত। গত ১০ বছরে আইপিও’র মাধ্যমে প্রতিবছর গড়ে ৬০০ থেকে ৭০০ কোটি টাকা পুঁজিবাজার থেকে উত্তোলন করা হয়েছে । ফ্লোর প্রাইস আরোপের মতো কিছু ভুল সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। আশা করি রেগুলেটর ভবিষতে এই ধরনের সিদ্ধান্ত থেকে বিরত থাকবে।

তিনি আরও বলেন, আমাদের মার্কেট ক্যাপ টু জিডিপি রেশিও পার্শ্ববর্তী দেশের তুলনায় অনেক কম। এটিকে বৃদ্ধি করার উপায় বের করতে হবে। আমাদের মার্কেটের আকারের তুলনায় ইন্টারমিডিয়ারিজ এর সংখ্যা অনেক বেশি । যার ফলে রেগুলেটরদের পক্ষে তাদের মনিটর করা অনেক কঠিন।

শিল্প ঋণের বিষয়ে ডিএসই’র চেয়ারম্যান জনাব মমিনুল ইসলাম বলেন, দেশের শিল্প উদ্যোক্তারা দীর্ঘমেয়াদী শিল্প ঋণের জন্য ব্যাংকের দ্বারস্থ হচ্ছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের পলিসি ফ্রেমওয়ার্কের সংশোধনের মাধ্যমে উদ্যোক্তাদের পুঁজিবাজার মুখী করার উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি। অতীতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা পুঁজিবাজারে যে অযাচিত হস্তক্ষেপ করেছে ভবিষ্যতে এ রকম যাতে না হয় সেজন্য রেগুলেটরি ফ্রেমওয়ার্কে সংস্কার করতে হবে। রেগুলেটর অপারেটরের ভূমিকায় চলে আসলে এক্সচেঞ্জের কার্যক্রম সংকুচিত হয়ে যায়। ভাল প্রতিষ্ঠানগুলো পুঁজিবাজারে না আসার কারণ খুঁজে এটি থেকে উত্তরণের জন্য কাজ করতে হবে। তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর আর্থিক প্রতিবেদনগুলোর বিশ্বস্ততা বৃদ্ধি করার জন্য এফআসির ভূমিকা রাখতে হবে। আমাদের মার্কেট ইন্টারমিডিয়ারিজের ক্যাপাসিটি ও গভার্ন্যান্সকে শক্তিশালী করতে হবে। ক্যাপিটাল গেইন ট্যাক্স এর সমস্যা সমাধানের জন্য আমি ডিএসই ‘র পক্ষ থেকে অর্থ উপদেষ্টা ও এনবিআর এর চেয়ারম্যানকে ধন্যবাদ জানাই । এছাড়াও আমাদের বর্তমানের পুঁজিবাজারের প্রতি আস্থা ফেরানোর জন্য ফিসক্যাল পলিসি সাপোর্ট খুবই গুরুত্বপূর্ণ্। রিজিওন্যাল মার্কেটের যে সমস্ত বিষয় প্রচলিত রয়েছে সেগুলোতে অনুসরণ করে বিনিয়োগকারীদের আস্থা বৃদ্ধি করতে চাই।

বিশেষ অতিথি বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদ বলেন, পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডাররা যদি তাদের নিজ নিজ দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন না করেন তাহলে বিএসইসি’র একার পক্ষে পুঁজিবাজার সার্বিক পরিস্থিতি উন্নয়ন করা সম্ভব নয়। আমাদের যে বিষয়গুলো আছে, সেগুলো আমরা আমাদের ট্রান্সফোর্স-এর সামনে রেখেছি। আমরা নিজেরা সব কিছু করার চেষ্টা করছি না। রাষ্ট্রের যে সংস্কার হচ্ছে তার অংশ হিসেবে আমরা কাজ করছি। আমরা মন্ত্রণালয়ের সাথে আইপিও সহজিকরণ, মিউচ্যুয়াল ফান্ড, মার্জিন লোন সংশোধন এবং নেগেটিভিটি নিয়ে কাজ করছি।

তিনি আরও বলেন, বিএসইসি’র মূল কাজ হওয়া উচিত দীর্ঘমেয়াদি পলিসি প্রণয়ন এবং এর প্রয়োগ। ঠিক সেটাতেই আমরা মনোনিবেশ করতে করছি। তিনি আরও উল্লেখ করেন, গত চারমাসে আমরা বাজারে ইন্টারমিডিয়ারিজদের হস্তক্ষেপ করিনি। বরং তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধির উপর জোড় দিয়েছি। আমরা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় “The scope of the role of the capital market” বাস্তবায়ন করতে চাই। একটা কোম্পানি ফাইন্যান্সিং-এ দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করে, কতটা মানি মার্কেটে থেকে মূলধন সংগ্রহ করবে, আর কতটা ক্যাপিটাল মার্কেট থেকে মূলধন সংগ্রহ করবে, সেই বিষয়টার স্টাকচারটা এখনো তৈরি হয়নি। মানি মার্কেটের স্ট্যাবিলিটির জন্য ক্যাপিটাল মার্কেট প্রয়োজন। এজন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের সাথে আমরা আলোচনা করছি। একটা কোম্পানির লংটার্ম ফাইন্যান্সিং প্রয়োজন হলে, সেটি পুঁজিবাজার থেকে নিতে হবে। এই কাজ করতে পারলে আমাদের সমস্যা অনেকটাই সমাধান হয়ে যাবে। এক্ষেত্রে কোম্পানিগুলোর পুঁজিবাজারে রেগুলেটরি কমপ্লায়েন্সের জন্য এক্সটা কস্ট থাকবে, সেটার জন্য নন-লিস্টেড কোম্পানি সাথে ট্যাক্স ডিফারেন্সটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই এ ব্যাপারে এনবিআরসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সহযোগিতা প্রয়োজন। বাংলাদেশ ব্যাংক, এনবিআর, বিএসইসি, ইডরা, এফআরসি, আইসিবিসহ সংশ্লিষ্ট স্ট্যাকহোল্ডাররা যদি একটা সিংক্রোনাইজেশনের মধ্যে না চলে, ক্যাপিটাল মার্কেট বা মানি মার্কেট কোনটাই সঠিকভাবে কার্যকর হবে না।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব নাজমা মোবারেক (Nazma Mobarek) বলেন, এখানে মাননীয় অর্থ উপদেষ্টাসহ এনবিআর, এফআরসি, ইডরা, মার্চেন্ট ব্যাংক, আইসিবি সহ পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট সকল স্টেকহোল্ডারের উপস্থিতিতে এ ধরনের একটি সম্মিলিত আলোচনা এবং সকলের মতামত পাওয়া সত্যিকার অর্থেই একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান যেমনটা বলেছেন যে, এই সময়টা হচ্ছে সংস্কারের সময়। এখন পর্যালোচনার সময় এসেছে কোথায় আমাদের গ্যাপ আছে, কোথায় চ্যালেঞ্জ আছে, এগুলো মোকাবেলা করার জন্য কি কি কৌশল অবলম্ভবন করা যায়, সে ব্যাপারে পদক্ষেপ নেওয়া। ব্যাংকগুলো সর্ট টার্ম ডিপোজিট নিয়ে লং টার্ম ঋণ দিচ্ছে। এখানে ম্যাচ্যুউরিটি মিসম্যাচ হচ্ছে। এই ম্যাচ্যুউরিটি মিচম্যাচের কারণে আমাদের ব্যাংকগুলো দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। আমাদের ব্যাংকগুলোকে হেলদি রাখার জন্য লংটার্ম ফাইন্যান্সিং ক্যাপিটাল মার্কেট থেকে করতে হবে। এজন্য আমাদের বিএসইসি’র চেয়ারম্যান ইতমধ্যেই বলেছেন যে, আমাদের ফিসক্যাল পলিসি সাপোর্ট দরকার। আমরা দেখেছি লিস্টেড কোম্পানি এবং নব-লিস্টেড কোম্পানি এদের মধ্যে ট্যাক্স ডিফারেন্স খুব একটা বেশি না। এক্ষেত্রে কোম্পানিগুলোর পুঁজিবাজারে আসতে আগ্রহ কম থাকে। এখানে এনবিআর কর্তৃপক্ষ আছেন, তারা দেখতে পারে কিভাবে ট্যাক্স বেনিফিট দিয়ে কোম্পানিগুলোর আগ্রহ বাড়ানো যায়। আমরা মনে করছি, এখানে আলোচনার মাধ্যমে একটা যৌক্তিক অবস্থানে পৌঁছাতে পারবো। এছাড়াও একটা কোম্পানিকে আইপিও’র মাধ্যমে পুঁজিবাজারে আসতে অনেক প্রসিডিউর, কমপ্লায়েন্স এবং দীর্ঘপক্রিয়া পার করতে হয়। তাই এই পক্রিয়া সহজ করে কিভাবে ভালো কোম্পানিগুলোকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত করা যায় সেদিকেও আমরা নজর দিতে পারি।

ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট সাইফুল ইসলাম বলেন, বাজারের মূল সমস্যা হচ্ছে স্বচ্ছতার অভাব, জবাবদিহিতার অভাব, বিনিয়োগযোগ্য সিকিউরিটিজ এর অভাব। এখানে ১০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করলে ১০ থেকে ২০টার বেশি সিকিউরিটিজ পাওয়া যাচ্ছে না। আর একটা বিষয় হচ্ছে প্রয়োজনের বেশি মার্কেট ইন্টারমিডিয়ারিজ। বাংলাদেশের দ্বিতীয় স্টক এক্সচেঞ্জ চিটাগাং স্টক এক্সচেঞ্জ যার ট্রেড ভলিউম ১০ থেকে ২০ কোটি টাকা। তাহলে আন্তর্জঅতিক পর্যায়ে এর কোন মূল্য থাকে না। গত ১৫ বছরে স্টক এক্সচেঞ্জকে ডিসফাংশনাল করা হয়েছে। যার হাতিয়ার হিসেবে ছিলো ডিমিউচ্যূয়ালাইজেশন স্কিম ও ডিমিউচ্যুয়ারাইজেশন এ্যাক্ট। যখন এটা করা হয় তখন বলা হয়েছিল ৫ বছর পর এটা রিভিউ করা হবে। কিন্তু আজকে ১০ বছরের উপরে হয়ে গেছে কিন্তু এই আইনের কোন রিভিউ করা হয়নি। আমরা বিশেষভাবে অনুরোধ করবো এই ডিমিউচ্যুয়ালাইজেশন আইনটা রিভিউ করার জন্য। আমরা বিএসইসিকে একটা উচ্চ পর্যায়ের পলিসি মেকার হিসেবে দেখতে চাই।বিশ্বে অন্যান্য দেশে যেমন আমেরিকা, জাপান, চীন ইন্টারমিডিয়ারিজদের দিয়ে একটা অর্গানাইজেশন গঠন করা হয়েছে। যা মার্কেট ইন্টারমিডিয়ারিজদের গভার্ন করে। ফিসকাল এবং মনিটরিং পলিসির ক্ষেত্রে বিএসইসি’র সময় অনেক বেশি লাগে। এক্ষেত্রে স্টক এক্সচেঞ্জের যদি আমরা ফাংশনাল করতে পারি, তাহলে এই কাজগুলো স্টক এক্সচেঞ্জই করতে পারে। ইন্ডিয়াতে গত ৩০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মার্কেট ক্যাপ হয়েছে সাপ্লাই চেইনের কারণে। তারা বিভিন্ন মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলোকে তাদের স্টক এক্সচেঞ্জগুলোতে তালিকাভুক্ত করতে পেরেছেন। বর্তমানে আমাদের দেশের মাল্টন্যাশনাল কোম্পানিগুলোকে তালিকাভুক্ত করার একটা সুযোগ রয়েছে। যা কোন পলিটিক্যাল গভর্নমেন্ট দ্বারা আদায় করা প্রায় অসম্ভব। তাই মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিসহ সরকারের কাছে যে শেয়ারগুলো রয়েছে তা পুঁজিবাজারে আনার এখনই উপযুক্ত সময়। যা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করবে।

বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট মাজেদা খাতুন বলেন, আমাদের দীর্ঘমেয়াদে অর্থায়নের ক্ষেত্রে পুঁজিবাজার থেকে এক শতাংশের কম অর্থায়ন হয়। সরকারের অর্থায়ন পলিসিতে পুঁজিবাজারকে অন্তর্ভূক্ত করা হয় তাহলে অনেক ভাল হবে। বর্তমানে আরজেএসসিতে দুই লক্ষের অধিক কোম্পানি রেজিস্ট্রার্ড রয়েছে, সে কোম্পানিগুলোর কাজ করার ক্ষেত্রে মার্চেন্ট ব্যাংকে সুযোগ করে দিতে হবে। এছাড়াও সকল পলিসি জনস্বার্থে বা বৃহত্তর স্বার্থে নেয়া প্রয়োজন। পুঁজিবাজারের উন্নয়নের জন্য গভর্মেন্ট বন্ড ইস্যু করা গেলে এক্ষেত্রে ব্যাংকিং সেক্টরে কম চাপ পড়বে। বিনিয়োগকারীরা যাতে বিভিন্ন প্রোডাক্ট ইস্যু করার ক্ষেত্রে এনবিআর থেকে কোন পলিসি সাপোর্ট দেয়া যায় তবে বিনিয়োগকারীরা উপকৃত হবে। এছাড়াও পুঁজিবাজারে ভাল কোম্পানি বৃদ্ধি করতে হবে একই সাথে নেগেটিভ ইক্যুইটি নিয়ে কাজ করতে হবে।

বিআইপিবি এ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির সিইও শহীদুল ইসলাম বলেন, আমাদের দেশের কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদনগুলোকে বিশ্বাস করা যায় না। যে কারণে সরকার ট্যাক্স পায়না সে কারণে পুঁজিবাজারের উন্নয়ন হয় না। আমাদের রেগুলেটরদের যে কাজ করা প্রয়োজন সেগুলো করা হয় নি। রেগুলেটরদের তাদের নির্ধারিত কাজ করতে হবে এতে মার্কেট কি হবে এটি দেখার বিষয় নয়। এ কাজগুলো করা হয়নি বলে আজ এ অবস্থা। আজকে সঠিক কাজ অর্থাৎ এনফোর্সমেন্ট অ্যাকশন নিয়ে কয়েকবছর পর বাজার ভাল হবে। আর্থিক প্রতিবেদনের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। আর যেসব ভুল হয়েছে সেগুলো সংশোধন করতে হবে।
আইসিবি’র চেয়ারম্যান আবু আহমেদ বলেন, আইসিবি একটি সরকারি ইনভেস্টমেন্ট প্রতিষ্ঠান। এটির একটি জবাবদিহিতা থাকা উচিত। ১৫ বছর আগে প্রতিষ্ঠানটি অনেক রিসোর্সফুল ছিল। কিন্তু এটি কেন দুর্বল হলো তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। আমি নমনীয়ভাবে আর্থিক উপদেষ্টাকে আইসিবি’র অবস্থান তুলে ধরলাম। আমি বললাম আইসিবিকে যদি বাঁচাতে হয়, তবে কিছু টাকা দেন। একটি ওয়ার্ক প্ল্যানের মাধ্যমে আইসিবিকে তিন হাজার কোটি টাকা দেয়া হলো। কিন্তু এর মধ্যে দুই হাজার কোটি টাকার ঋণ পরিশোধ করা হয়েছে। বাকি এক হাজার কোটি টাকা থেকে প্রতিদিন ২০ থেকে ৩০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করছি। আমরা শুধুমাত্র বেস্ট অব দি বেস্ট শেয়ার কিনছি এবং এটি আলাদা বিও একাউন্টে কেনা হচ্ছে। এছাড়া আইসবির ৯,৬০০ কোটি টাকার উপরে ঋণ আছে, সেগুলো আইসিবি বন্ড ইস্যু করেছে অথবা সরকারের বিভিন্ন খাত ঋণ নিয়েছে। আমাদের বাজারে সাপ্লাই বাড়াতে হবে, কোয়ালিটি সম্পন্ন শেয়ার আনতে হবে। মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলোকে তালিকাভুক্ত করার জন্য চেষ্টা করতে হবে। তাদেরকে ঠিক মতো এপ্রোচ করলে আশা করি তারা তালিকাভুক্ত হবে।

পুঁজিবাজার বিষয়ক ট্রাস্ক ফোর্সের চেয়ারম্যান এ. কে. এম মাজেদুর রহমান বলেন, পুঁজিবাজারে সবচেয়ে বেশি কর অব্যাহতি দেয়া হয়েছে প্রায় সাড়ে ১১ হাজার কোটি টাকা। এই অব্যাহতির পেছনে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের অবদান রয়েছে। এই অব্যাহতি যেমন দিতে হবে, একইসাথে ট্যাক্স আদায়ও করতে হবে। এখন আগামী অর্থবছরের বাজেট প্রণয়নের কাজ চলছে। তাই এই বিষয়টি নজরে রাখতে হবে। একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি ৫ শতাংশ ট্যাক্স ডিফারেন্স এর জন্য পুঁজিবাজারে আসতে চাইবে না। তাই এই ট্যাক্স ডিফারেন্স কমপক্ষে ১০ শতাংশ করা প্রয়োজন। অনেক আগে এফডিআই-তে ৩২ টা কোম্পানি একটা তালিকা করা হয়েছিল। সেখানে গভার্নমেন্টের কিছু কোম্পানিকে ডাইরেক্ট লিস্টিং এর মাধ্যমে পুঁজিবাজারে নিয়ে আসা কথা বলা হয়েছিল। সে বিষয়ে আমাদের নজর দিতে হবে। বৈদেশিক বিনিয়োগ প্রসঙ্গে জনাব মাজেদুর রহমান বলেন, ফরেন ইনভেস্টরদের বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ডাবল টেক্সেশন (double taxation) বিষয়টা নজর দিতে হবে। আমাদের ফান্ডামেন্টাল যে ইস্যুগুলো আছে, সেগুলো নিয়ে ট্রান্সফোর্স কাজ করছে। আমাদের রিটেইল ইনভেস্টরা না জেনে বুঝে বিনিয়োগ করে ক্ষতির সম্মুখিত হয়। সে ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে হবে। এই বিনিয়োগগুলো যদি মিউচ্যুয়াল ফান্ড বা এ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট এর মাধ্যমে আসে, সেই বিষয়ে আমরা আস্তে আস্তে কমিশনের মাধ্যমে পদক্ষেপ নিতে পারি। সিসিবিএল এবং সিডিবিএল কে একত্রীকরণ করে তাদের কার্যক্রম কিভাবে আরও কার্যকর করা যায়, সে ব্যাপারেও কাজ করা যেতে পারে। তিনি আমাদের ক্যাপিটাল মার্কেটে ৬০০ এর বেশি ইন্টারমেডিয়ারিজ আছে। এক্ষেত্রে আর যেন অতিরিক্ত লাইসেন্স ইস্যু করতে না পারা যায় তার একটি প্রদ্ধতি প্রনয়নের ব্যাপারে নজর দেয়া উচিত বলে উল্লেখ করেন।।

ডিএসই’র পরিচালক মিনহাজ মান্নান ইমন বলেন, বিএসইসির বর্তমান নেতৃত্বের কারণে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ একটি দক্ষ বোর্ড পেয়েছে। বর্তমান কমিশনের বয়স মাত্র তিন থেকে চার মাস। সততার জায়গায় যদি সঠিকভাবে কাজ করে, তবে বাজারের উন্নয়ন তরান্বিত হবে। দক্ষ নেতৃত্বের মাধ্যমে যদি বিভিন্ন প্রয়োজনীয় বিষয় বিবেচনা করা হয়, তাহলে পুঁজিবাজার দ্রুততম সময়ের মধ্যে ঘুড়ে দাঁড়াবে।

বাংলাদেশ সরকারের অর্থমন্ত্রণালয় এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, শেয়ারবাজারে কিছু সংস্কার হচ্ছে। সব সংস্কারেরই কিছু যন্ত্রণা থাকে। তাই শেয়ারবাজারের সংস্কার কার্যক্রমেরও কিছু যন্ত্রণা সাময়িকভাবে সইতে হবে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের অবস্থান হচ্ছে শেয়ারবাজারকে শক্তিশালী করা। ব্যাংকের ঋণনির্ভর অর্থনীতি টেকসই কোনো অর্থনীতি নয়। ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে শিল্প গড়লে অনেক সময় টাকা ফেরত না দিলেও চলে। এ কারণে আমাদের দেশে শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ার ক্ষেত্রে ব্যাংক ঋণনির্ভরতা বেশি।

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আমাদের শেয়ারবাজারের গভীরতা অনেক কম। ভালো ভালো কোম্পানিগুলো এই বাজারে আসতে খুব বেশি আগ্রহী নয়। এসব কোম্পানির মালিকেরা ভাবেন, ছেলে হবে পরিচালক, বউ চেয়ারম্যান। ব্যবসায় যা মুনাফা হবে, তা নিজেরা ভোগ করবেন। শেয়ারবাজারে আসা মানেই ভালো ব্যবস্থাপনা, করপোরেট সুশাসন ইত্যাদি উন্নত হওয়া। কিন্তু অনেকে এসব বিষয়ে প্রশ্নের মুখোমুখি হতে চান না। তাই তাঁরা বাজারে আসতে আগ্রহী নন। কিন্তু সময় এসেছে বাজারের গভীরতা বাড়ানোর। এ জন্য ভালো ভালো কোম্পানি বাজারে আনতে হবে। আর তার জন্য করের সুবিধাসহ সরকারি যেসব নীতি–সহায়তা দরকার, সেসব বিষয় সরকার বিবেচনা করবে। কিছু সরকারি কোম্পানি বাজারে আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।’

অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আমাদের দেশে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়েরও বড় সমস্যা রয়েছে। সেই সঙ্গে দলগতভাবে দেশের কল্যাণে কাজ করার উদ্যোগেরও ঘাটতি আছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির মধ্যে সমন্বয় বা যোগাযোগ আগের চেয়ে অনেক কমে গেছে। শেয়ারবাজারের স্বার্থে এই যোগাযোগ ও সমন্বয় বাড়ানোর পাশাপাশি দলগতভাবে কাজ করার ক্ষেত্রে বাজার–সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে এগিয়ে আসতে হবে।’
শেয়ারবাজারে প্রবাসী বাংলাদেশিদের বিনিয়োগ বাড়াতে উদ্যোগ গ্রহণের জন্য ডিএসইসহ শেয়ারবাজার–সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের প্রতি আহ্বান জানান সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, ‘ভারতের শেয়ারবাজারে দেশটির প্রবাসীদের বড় ধরনের বিনিয়োগ রয়েছে। আমাদের প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যেও অনেকের বিনিয়োগের সামর্থ্য রয়েছে। তাঁদের বিনিয়োগের জন্য উৎসাহিত করতে হবে। আর এ জন্য বাজারকে আকর্ষণীয় করতে হবে।’

এ সময় ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ আরও বলেন, ‘শেয়ারবাজারে সূচক বাড়লেই সবাই খুশি হন। কিন্তু বাজার যখন বেশি ওপরের দিকে যায়, তখন একটু সতর্ক হতে হবে। অনেক সময় নিয়ন্ত্রক সংস্থার ভুল নীতির কারণেও শেয়ারবাজারে সমস্যা দেখা দেয়। সাধারণ বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হন। অতীত অভিজ্ঞতায় দেখেছি, ব্যাংকগুলো বাজারে বেশি বিনিয়োগ করায় বাজার অনেক ওপরে উঠে গিয়েছিল। এরপর হঠাৎ ব্যাংকগুলোকে বিনিয়োগ কমিয়ে আনার নির্দেশ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। তাতে বাজার ক্ষতিগ্রস্ত হয়।’

পরিশেষে, বিএসইসি’র চেয়ারম্যান, ফিনান্সিয়াল ইন্সটিটিউড ডিভিশন-এর সচিব, ডিএসই’র চেয়ারম্যান এবং অন্যান্য স্টেকহোল্ডারগণ পুঁজিবাজার উন্নয়নে বিভিন্ন বিষয়ে খোলামেলা আলোচনা করেন।

৩ উত্তর “পুঁজিবাজারের উন্নয়ন ও বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে গোলটেবিল বৈঠকে যা বললেন বক্তারা”

আপনার মতামত দিন

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.