শুল্ক ও কর বৃদ্ধি যেভাবে প্রভাব ফেলবে সিগারেটের বাজারে
নিজস্ব প্রতিবেদক: মূল্য সংযোজন কর (মূসক) ও সম্পূরক শুল্ক বৃদ্ধির সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তে উল্লেখযোগ্যভাবে দাম বেড়েছে সিগারেটের বিভিন্ন ব্র্যান্ডের, সরাসরি যার প্রভাব পড়েছে সিগারেটের বাজারে।
আকস্মিকভাবে শুল্ক ও কর বৃদ্ধি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন খাতসংশ্লিষ্ট অংশীজনেরা। তাদের মতে, এ সিদ্ধান্তের কারণে বাজারে চাহিদা কমবে এবং যার ধারাবাহিকতায় কমে আসবে সরকারের রাজস্ব আয়। এক্ষেত্রে, উৎকণ্ঠার আরও বিষয় হচ্ছে, সিগারেটের দাম বৃদ্ধির কারণে অবৈধ সিগারেটের বাজার বড় হতে পারে; যা রাজস্ব আয়কে আরও সংকুচিত করবে।
নতুন শুল্ক ও কর পরিশোধের পরেই নিজেদের পণ্য বাজারে ছেড়েছে সিগারেট প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। যে কারণে প্রায় সব ধরনের সিগারেটের দামই শলাকাপ্রতি বেড়েছে এক থেকে দুই টাকা।
সিগারেটসহ শতাধিক পণ্য ও সেবার ওপর ৯ জানুয়ারি থেকে শুল্ক ও কর বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। বেড়েছে সিগারেটের দামও। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ইতোমধ্যেই নতুন মূল্যের ভিত্তিতে স্ট্যাম্প ও ব্যান্ড রোল ব্যবহারের নির্দেশনা জারি করেছে।
ফরেন ইনভেস্টরস’ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফআইসিসিআই) সম্প্রতি তাদের বিবৃতিতে জানিয়েছে, অংশীজনদের সাথে আলোচনা না করে শুল্ক ও কর বৃদ্ধি ব্যবসাখাত ও বিনিয়োগকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
উল্লেখ্য, তামাক, টেলিযোগাযোগ, জ্বালানি ও আর্থিক খাতসহ বিভিন্ন খাতে ৯০ শতাংশ প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের (এফডিআই) প্রতিনিধিত্ব করে এফআইসিসিআই। সংগঠনটি আরও জানায়, শুল্ক ও কর বৃদ্ধির মত পদক্ষেপ বিনিয়োগকারীদের আস্থা ও আত্মবিশ্বাসে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে এবং ভবিষ্যতে দেশে এফডিআই প্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করবে।
এ বিষয়ে বিএটি বাংলাদেশের হেড অব করপোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স শাবাব আহমেদ চৌধুরী বলেন, “বিএটি বাংলাদেশ এ অঞ্চলে ১১৫ বছর ধরে ব্যবসা পরিচালনার মাধ্যমে আমরা জাতীয় প্রবৃদ্ধিতে সক্রিয়ভাবে অবদান রেখে চলেছি। দেশের রাজস্বের অন্যতম বৃহৎ অংশীদার হিসেবে আমরা মনে করি, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের এ ধরনের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের আগে অংশীজনদের সাথে অন্তর্ভুক্তিমূলক আলোচনা করে নেয়া প্রয়োজন ছিলো। বাংলাদেশে সিগারেট ট্যাক্স ডব্লিউএইচও’র নির্দেশিত মাত্রা (৭৫ শতাংশ) ইতোমধ্যে অতিক্রম করে গেছে। এক্ষেত্রে, এটি বেড়ে ৮৩ শতাংশ হলে, অবশ্যই তা এই খাতের দীর্ঘমেয়াদী ভবিষ্যতের জন্য উৎকণ্ঠার বিষয় হবে। এই পরিবর্তনের কারণে বেশকিছু নেতিবাচক ও অনাকাঙ্ক্ষিত ফলাফল দেখা দিবে। যা সামগ্রিকভাবে ব্যবসা ও বিনিয়োগের ওপর প্রভাব ফেলবে, বাজারে অবৈধ সিগারেটের যোগান বাড়াবে; এবং দীর্ঘমেয়াদে সরকারের রাজস্বের ক্ষতি করবে। পাশাপাশি, এই সিদ্ধান্ত তামাক খাত এবং এর সাথে সম্পর্কিত বিস্তৃত ভ্যালু চেইনের প্রায় ৪৪ লাখ মানুষের জীবিকায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে, যার মধ্যে রয়েছে কৃষক, খুচরা বিক্রেতা এবং পরিবেশক। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, সরকারের উচিত খাতসংশ্লিষ্ট সকল অংশীজনের সাথে অন্তর্ভুক্তিমূলক আলোচনা শুরু করা; এবং হতাশাজনক এই সিদ্ধান্ত অবিলম্বে পুনর্বিবেচনা করা।”
খুচরা বাজারে প্রতি শলাকার দাম বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, আগে বেনসন অ্যান্ড হেজেস ব্র্যান্ডের সিগারেটের প্রতি শলাকা ১৮ টাকা করে বিক্রি হত, এখন সেটা হচ্ছে ২০ টাকায়। গোল্ড লিফ ব্র্যান্ডের সিগারেটের প্রতিটি শলাকার দাম বেড়ে হয়েছে ১৩ থেকে ১৫ টাকা। একইভাবে, লাকি স্ট্রাইক সিগারেটের দাম শলাকাপ্রতি বেড়ে ১০ টাকা থেকে ১২ টাকা ও স্টারের প্রতি শলাকা ৮ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ১০ টাকা। ডার্বি, পাইলট ও হলিউড সিগারেটের প্রতি শলাকার দাম এখন ৮ টাকা এবং রয়্যালসের শলাকাপ্রতি দাম বর্তমানে ৭ টাকা।
সিগারেটের ব্র্যান্ডগুলোর ২০ শলাকার প্রতিটি প্যাকেটে ২০ থেকে ৩০ টাকা দাম বেড়েছে। পাইকারি বাজারে ২০ শলাকার বেনসন অ্যান্ড হেজেস ব্র্যান্ডের সিগারেটের প্যাকেটের মূল্য ৩৭০ টাকা, জন প্লেয়ার গোল্ড লিফ ২৮০ টাকা, লাকি স্ট্রাইক ২১০ টাকা, স্টার ১৭২ টাকা, পাইলট ডার্বি স্টাইল ও হলিউড ১৪৪ টাকা এবং রয়্যালস ১২৬ টাকা।
এনবিআরের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, নিম্নস্তরের সিগারেটের ক্ষেত্রে ১০ শলাকার প্যাকেটের দাম ৫০ টাকা থেকে বেড়ে ৬০ টাকা বা তার অধিক হয়েছে। এক্ষেত্রে, সম্পূরক শুল্ক বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ৬০ শতাংশ থেকে ৬৭ শতাংশ। মধ্যস্তরের সিগারেটের ক্ষেত্রে সম্পূরক শুল্ক ৬৫.৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ৬৭ শতাংশ হয়ে দাম বেড়ে হয়েছে ৭০ টাকা থেকে ৮০ টাকা বা তারও বেশি। উচ্চস্তরের সিগারেটের ক্ষেত্রে দাম ১২০ টাকা থেকে বেড়ে ১৪০ টাকা বা তার অধিক হয়েছে এবং এক্ষেত্রে সম্পূরক শুল্ক ৬৫.৫ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ৬৭ শতাংশ। প্রিমিয়াম সিগারেটের ক্ষেত্রে দাম ১৬০ টাকা থেকে বেড়ে ১৮৫ টাকা বা তার বেশি হয়েছে এবং সম্পূরক শুল্ক বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ৬৫.৫ শতাংশ থেকে ৬৭ শতাংশ।
সিগারেটের মোড়কে ব্যান্ড রোল থাকা আবশ্যক। সিগারেটের প্যাকেট বাজারজাত করার আগে সিগারেট প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো কারখানায় মোড়কে ব্যান্ড রোল যুক্ত করে। সরকার ব্যান্ড রোল বিক্রির মাধ্যমে সিগারেট থেকে রাজস্ব সংগ্রহ করে। বাংলাদেশে সিগারেট ও তামাক খাত সর্বোচ্চ রাজস্ব আয়কারী খাত। সিগারেট প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রতিটি শলাকার মূল্যের প্রায় ৬০ শতাংশ থেকে ৮০ শতাংশ কর ও শুল্ক হিসেবে পরিশোধ করতে হয়। ২০২৩–২৪ অর্থবছরে এনবিআর এ খাত থেকে শুল্ক ও কর হিসেবে ৩৭,৯১৫ কোটি টাকা আদায় করেছে, যা পরিশোধ করেছে সিগারেট বিক্রয়কারী ৩১টি প্রতিষ্ঠান। অন্যদিকে, আগের অর্থবছরে ভ্যাট বিভাগ শুল্ক ও কর হিসেবে সিগারেট বিক্রি থেকে আদায় করেছিল ৩২,৮১৬ কোটি টাকা।