শেয়ার কারসাজিতে ১৮ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ১৯০ কোটি টাকা জরিমানা

নিজস্ব প্রতিবেদক : পুঁজিবাজারে দুই তালিকাভুক্ত কোম্পানির শেয়ার কারসাজির ঘটনায় ৯ ব্যক্তি ও ৯ প্রতিষ্ঠানকে মোট ১৮৯ কোটি ৯৫ লাখ টাকা জরিমানা করেছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। দীর্ঘদিন ধরে বাজারে গুঞ্জন থাকলেও এতদিন বিষয়টি প্রমাণিত হয়নি। তবে বিস্তর তদন্ত শেষে কমিশন নিশ্চিত হয়েছে যে, নির্দিষ্ট কিছু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান অস্বাভাবিক শেয়ার কেনাবেচার মাধ্যমে কৃত্রিম মূল্য বৃদ্ধি ঘটিয়ে বাজারকে প্রভাবিত করেছে এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ক্ষতির মুখে ফেলেছে।
শেয়ার কারসাজির ঘটনায় অভিযুক্ত কোম্পানি দুটি হলো সি পার্ল বিচ রিসোর্ট অ্যান্ড স্পা লিমিটেড ও সোনালী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড। তদন্তে উঠে এসেছে, দীর্ঘ পরিকল্পনার মাধ্যমে একাধিক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান বেনিফিশিয়ারি ওনার্স (বিও) হিসাব ব্যবহার করে অবৈধভাবে শেয়ার কেনাবেচা চালিয়েছে এবং শেয়ারের দর অস্বাভাবিকভাবে বাড়িয়ে নিয়েছে।
সি পার্ল বিচ রিসোর্টের শেয়ার কারসাজি
২০২২ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২৩ সালের ১০ আগস্ট পর্যন্ত সময়ে সি পার্ল বিচ রিসোর্ট অ্যান্ড স্পা লিমিটেডের শেয়ারের মূল্য ৪০০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যায়। ২০২২ সালের ৩ জুলাই কোম্পানিটির শেয়ারের দাম ছিল ৪৩.৫০ টাকা, যা কারসাজির মাধ্যমে ২০২৩ সালের ১০ আগস্ট ২১৭.৪০ টাকায় পৌঁছে।
বিএসইসির তদন্তে উঠে এসেছে, একাধিক প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি একযোগে সিরিজ ট্রেডিং কৌশল ব্যবহার করে পরিকল্পিতভাবে শেয়ারের দর বাড়িয়েছে। বাজারে শেয়ার সংকট দেখিয়ে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করা হয় এবং পরে বাড়তি দামে শেয়ার বিক্রি করে তারা মোটা অঙ্কের মুনাফা হাতিয়ে নেয়।
এই কারসাজির ঘটনায় ৯ প্রতিষ্ঠান এবং ৪ ব্যক্তিকে সর্বমোট ১৮৭ কোটি ২২ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে।
অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ইউডিসি কনস্ট্রাকশন, ভেনাস বিল্ডার্স, সাতরং অ্যাগ্রো ফিশারিজ, হৃদয় পোল্ট্রি ফার্ম, হাসান নার্সারি, আমানত অ্যাগ্রো ফিশারিজ, সাব্বির স্টোর, সরকার অ্যাগ্রো ফার্ম ও মুক্তা ফিশারিজ রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান একাধিক বিও হিসাব ব্যবহার করে বাজারে একটি কৃত্রিম চাহিদা তৈরি করে, যা মূলত শেয়ার কারসাজির অন্যতম বড় কৌশল।
ব্যক্তিদের মধ্যে মো. কালাম হোসেন, আবু সাদাত মো. ফয়সাল, জামরুল হাসান মো. ইকবাল গণি ও মো. আবু নাঈমকে জরিমানা করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা একাধিক অ্যাকাউন্ট থেকে একই দিনে বারবার শেয়ার কেনাবেচা করে বাজারকে বিভ্রান্ত করেছে এবং ধীরে ধীরে দর বাড়িয়ে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ভুল সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করেছে।
সোনালী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার কারসাজি
২০২৩ সালের ১৮ এপ্রিল থেকে ১১ জুন পর্যন্ত সোনালী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের শেয়ারের মূল্য ৭৯ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যায়। ২০২৩ সালের ১৭ এপ্রিল কোম্পানিটির শেয়ার দর ছিল ৬২.১০ টাকা, যা কারসাজির মাধ্যমে ১২ জুন ১১১.৫০ টাকায় পৌঁছে।
বিএসইসির তদন্তে উঠে এসেছে, একদল ব্যক্তি মিলিতভাবে বড় অঙ্কের শেয়ার কেনাবেচার মাধ্যমে বাজারকে প্রভাবিত করেছে। তারা পরিকল্পিতভাবে লেনদেন বাড়িয়ে দেখিয়েছে, যাতে শেয়ারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ বৃদ্ধি পায় এবং বাজারে মূল্য আরও বেড়ে যায়।
এই ঘটনায় পাঁচ ব্যক্তিকে মোট ২ কোটি ৭৩ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। অভিযুক্তদের মধ্যে রয়েছেন নূরজাহান বেগম, সাজিদুল হাসান, সায়েদুর রহমান, ফেরদৌসি বেগম ও লুতফর রহমান। তারা একাধিক বিও হিসাব ব্যবহার করে একই দিনে একাধিকবার শেয়ার কেনাবেচার মাধ্যমে বাজারকে বিভ্রান্ত করেছেন।
পুঁজিবাজারে অনেকদিন ধরেই অভিযোগ ছিল, কিছু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান বিশেষ কিছু কোম্পানির শেয়ারের দর কৃত্রিমভাবে বাড়িয়ে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ক্ষতির মুখে ফেলছে। তবে এতদিন এসব অভিযোগের পক্ষে পর্যাপ্ত প্রমাণ পাওয়া যায়নি। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর বিএসইসির নতুন নেতৃত্ব, বিশেষ করে চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদের কমিশন, বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত চালায় এবং অভিযুক্তদের শনাক্ত করে শাস্তির আওতায় আনে।
তদন্তে উঠে এসেছে, অভিযুক্ত ব্যক্তিরা নিজেদের অ্যাকাউন্ট এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে একাধিক বিও হিসাব ব্যবহার করে বারবার শেয়ার কেনাবেচা করেছে এবং একটি কৃত্রিম বাজার তৈরি করেছে। এই কর্মকাণ্ডের ফলে শেয়ারগুলোর বাজারমূল্য অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায় এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীরা উচ্চমূল্যে শেয়ার কিনতে বাধ্য হয়।
কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “এটি পুঁজিবাজারের স্বাভাবিক কার্যক্রমের সম্পূর্ণ পরিপন্থী এবং বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষার জন্য এ ধরনের কারসাজির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।”
তবে অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষ থেকে এ বিষয়ে এখনো কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
বিএসইসি স্পষ্টভাবে জানিয়েছে, ভবিষ্যতে শেয়ার কারসাজির কোনো ঘটনা ঘটলে তাৎক্ষণিক তদন্ত করে দোষীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কমিশন পুঁজিবাজারকে একটি নিরাপদ ও স্বচ্ছ বিনিয়োগের ক্ষেত্র হিসেবে গড়ে তুলতে বদ্ধপরিকর এবং কোনো ধরনের কারসাজিকে প্রশ্রয় দেওয়া হবে না।