করপোরেট বন্ড বাজারে ধস: ৪১ হাজার কোটি টাকার বন্ড ঝুঁকিতে

খালিদ হাসান : কোভিড-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের করপোরেট বন্ড বাজারে যে আশাব্যঞ্জক জোয়ার এসেছিল, তা এখন কার্যত থমকে গেছে। ২০২০ সালের মে থেকে ২০২৪ সালের জুলাই পর্যন্ত সময়কালে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) প্রায় ৪১ হাজার কোটি টাকার বন্ড অনুমোদন দিলেও বিনিয়োগকারীদের অনাগ্রহ এবং নীতিগত অসামঞ্জস্যতার কারণে এই বাজার গভীর সংকটে পড়েছে।
বিএসইসি সূত্রে জানা গেছে, অন্তত ২০টির বেশি প্রতিষ্ঠান নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বন্ড সাবস্ক্রিপশন সম্পন্ন করতে পারেনি। সময় বাড়ানোর আবেদন নিয়ে তারা কমিশনের দ্বারস্থ হয়েছে। তালিকায় রয়েছে দেশের নামকরা ব্যাংক ও কোম্পানি—প্রিমিয়ার ব্যাংক, ব্র্যাক ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক, ইউসিবি, রেনাটা, নভানা ফার্মাসিউটিক্যালস, সাজিদা ফাউন্ডেশনসহ আরও অনেকে।
খাতসংশ্লিষ্টদের মতে, বর্তমান বাজার পরিস্থিতিতে সরকারি ট্রেজারি বিল ও বন্ডে ১২.৫% পর্যন্ত নিশ্চিত রিটার্ন মিলছে, যেখানে করপোরেট বন্ডে এ হার ১০% বা তারও নিচে। ফলে ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও অন্যান্য প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী নিরাপদ ও লাভজনক বিকল্প হিসেবে সরকারি সিকিউরিটিজের দিকেই ঝুঁকছে। এতে করে করপোরেট বন্ড বাজার কার্যত বিনিয়োগশূন্য হয়ে পড়ছে।
শুধু রিটার্ন নয়, রাজনৈতিক অস্থিরতাও বিনিয়োগে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনিশ্চয়তা ও উত্তেজনার মাঝে নতুন বিনিয়োগে যেতে চাইছে না অনেক প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি। তার ওপর যুক্ত হয়েছে সামগ্রিক অর্থনীতির মন্দা—শেয়ারবাজারে দরপতন, মূল্যস্ফীতি, মুদ্রার অবমূল্যায়ন, ব্যাংক খাতের অনিয়ম—সব মিলে বিনিয়োগ আস্থা নড়বড়ে হয়ে পড়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এমনিতেই করপোরেট বন্ড বাজার দেশের জিডিপির মাত্র ০.১৯ শতাংশ, যা এশিয়ার অন্যতম ক্ষুদ্র বাজার। সেখানে বিনিয়োগকারীদের আস্থা হারালে বন্ড ইস্যু ও সাবস্ক্রিপশন প্রক্রিয়া পুরোপুরি মুখ থুবড়ে পড়বে।
২০২৪ সালের জানুয়ারিতে রেনাটা লিমিটেড বিএসইসির অনুমোদন পেয়েছিল ৬৬০ কোটি টাকার জিরো কুপন বন্ড ইস্যুর জন্য। সেই বন্ডের মাধ্যমে ব্যাংকঋণ পরিশোধের পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু এক বছরের বেশি সময় পার হলেও বন্ডটি এখনও সম্পূর্ণ সাবস্ক্রাইব হয়নি। পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ন্ত্রক সংস্থা একবার ছয় মাস এবং পরে আরও ছয় মাস সময় বাড়িয়ে দিয়েছে।
রেনাটার কোম্পানি সেক্রেটারি মো. জুবায়ের আলম বলেন, “সরকারি সিকিউরিটিজে উচ্চ সুদ ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা করপোরেট বন্ড থেকে বিনিয়োগকারীদের মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে ট্রেজারি ইল্ড কমতে থাকায় আমরা কিছুটা আশাবাদী।”
একজন অভিজ্ঞ অ্যাসেট ম্যানেজার জানান, ব্যাংকগুলো সাধারণত দুটি ধরনের বন্ড ইস্যু করে—ক্যাপিটাল বন্ড ও করপোরেট বন্ড। ক্যাপিটাল বন্ডে অন্তত ৫০% তহবিল ব্যাংকের বাইরে থেকে সংগ্রহ করতে হয়, যা বর্তমান বাজার পরিস্থিতিতে কঠিন। ফলে ঝুঁকি এড়াতে করপোরেট বন্ড থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে অনেক ব্যাংক।
ফলে এখন বন্ড ইস্যুকারীরা বাধ্য হচ্ছেন আরও বেশি রিটার্ন অফার করতে, যা তাদের জন্য অর্থনৈতিকভাবে টেকসই নয়।
বিশ্লেষকদের মতে, করপোরেট বন্ড বাজার টিকিয়ে রাখতে হলে এখনই নীতিগত হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। সরকারি সিকিউরিটিজ ও করপোরেট বন্ডে রিটার্ন ব্যবধান কমানো, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা এবং বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ গড়ে তোলার বিকল্প নেই।