নেগেটিভ ইক্যুইটির বোঝা ৭,৮২৪ কোটি টাকা: সমাধানে অর্থ মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপ চায় বিএসইসি

নিজস্ব প্রতিবেদক : ২০১০ সালের পুঁজিবাজার ধসের পর থেকে পুঞ্জিভূত হয়ে ওঠা ‘নেগেটিভ ইক্যুইটি’ সমস্যার চাপ ক্রমেই বাড়ছে দেশের পুঁজিবাজারে। বিনিয়োগকারীদের মার্জিন ঋণের বিপরীতে অনাদায়ী ক্ষতির ফলে তৈরি হওয়া এই দীর্ঘমেয়াদি আর্থিক সংকট এখন বাজারের স্বাভাবিক গতিধারার পথে অন্যতম বড় অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত দেশের ব্রোকারেজ হাউজ ও মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর সম্মিলিত নেগেটিভ ইক্যুইটির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ৫২৫ কোটি ২৮ লাখ টাকা। এর মধ্যে নিরাপত্তা সঞ্চিতি বা প্রভিশন বাদ দিলে প্রকৃত অনাদায়কৃত ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় ৭ হাজার ৮২৪ কোটি ১৮ লাখ টাকা।
এই বাস্তবতায় সমস্যাটির টেকসই সমাধানে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সহায়তা ও কার্যকর পরামর্শ কামনা করেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। এ লক্ষ্যে সম্প্রতি সংস্থাটি একটি চিঠি প্রেরণ করেছে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব বরাবর।
বিএসইসির পাঠানো ওই চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, ২০১০ সালের আকস্মিক দরপতনের পর থেকে বিনিয়োগকারীদের মার্জিন হিসাবে জমে থাকা অনাদায়কৃত ক্ষতিগুলো বছর বছর বেড়ে চলেছে। এসব ক্ষতি ‘নেগেটিভ ইক্যুইটি’ হিসেবে দীর্ঘ সময় ধরে বিনিয়োগকারীদের অ্যাকাউন্টে বহাল থেকেছে। কমিশন বিগত সময়ে বাজার মধ্যস্থতাকারীদের সঙ্গে একাধিক দফায় আলোচনা ও বিভিন্ন নীতিগত পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও সমস্যাটির কাঙ্ক্ষিত সমাধান আসেনি।
বিএসইসি মনে করে, এক্ষেত্রে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সক্রিয় সহযোগিতা ও দিকনির্দেশনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চিঠিতে আরও বলা হয়, বাজারে চলমান এ সংকট নিরসনে ডিএসই, সিএসই, সব ব্রোকারেজ হাউজ ও মার্চেন্ট ব্যাংকের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি সমন্বিত বৈঠক ডাকার জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগ কাম্য।
বিএসইসির হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (সিএসই) সদস্যভুক্ত ব্রোকারেজ হাউজ ও অনুমোদিত মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো বিনিয়োগকারীদের মোট ১ লাখ ৭৪ হাজার ৪৬৭টি মার্জিন অ্যাকাউন্টের বিপরীতে ১৮ হাজার ১২৮ কোটি ৭০ লাখ টাকার ঋণ দিয়েছে। এর মধ্যে ডিএসইর সদস্যভুক্ত ব্রোকারেজ হাউজগুলো দিয়েছে ১১ হাজার ৫৪৫ কোটি টাকা, মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো ৬ হাজার ৫৪৮ কোটি টাকা এবং সিএসইর সদস্যরা দিয়েছে প্রায় ৩৫ কোটি ৫৯ লাখ টাকা।
এই ঋণের বিপরীতে প্রকৃত নেগেটিভ ইক্যুইটি দাঁড়িয়েছে ডিএসইতে ৫ হাজার ১৪৪ কোটি টাকা, মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোতে ২ হাজার ৭০৯ কোটি টাকা এবং সিএসইতে প্রায় ৯ কোটি টাকা। এর সঙ্গে সুদের পরিমাণ যুক্ত হয়ে মোট হিসাব দাঁড়ায় ১০ হাজার ৫২৫ কোটি টাকা। যদিও ব্রোকারেজ হাউজ ও মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো মিলে এ পর্যন্ত প্রভিশন রেখেছে মাত্র ২ হাজার ৭০১ কোটি টাকা। ফলে প্রকৃত অনাদায়কৃত ক্ষতি তথা নেগেটিভ ইক্যুইটির পরিমাণ দাঁড়ায় ৭ হাজার ৮২৪ কোটি ১৮ লাখ টাকা।
২০২৩ সালের ২৭ মার্চ জারি করা বিএসইসির নির্দেশনায় বলা হয়েছিল, স্টক ডিলার ও মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোকে তাদের পোর্টফোলিওতে থাকা মার্জিন ঋণের বিপরীতে অনাদায়কৃত ক্ষতির জন্য ২০২৫ সালের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে প্রভিশন রাখতে হবে। তবে সেই সময়সীমা ইতোমধ্যেই শেষ হয়ে গেছে।
এ অবস্থায়, নেগেটিভ ইক্যুইটির চাপ সামলাতে বিএসইসির কাছে প্রভিশনিংয়ের সময়সীমা ২০৩০ সাল পর্যন্ত বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ডিবিএ)। একই সঙ্গে বিনিয়োগকারীদের আস্থা পুনঃস্থাপনে এবং ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তায় কার্যকর পরিকল্পনা গ্রহণের দাবি জানানো হয়েছে।
ডিএসই এবং ডিবিএ ইতোমধ্যে এ সংক্রান্ত বিষয়গুলো অবহিত করেছেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদকেও। বাজার সংশ্লিষ্টদের অভিমত, সরকারি সহযোগিতা ছাড়া এই দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা থেকে উত্তরণ সম্ভব নয়।
বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনা এবং বাজারের স্বাভাবিকতা বজায় রাখার স্বার্থে ‘নেগেটিভ ইক্যুইটি’ সমস্যা সমাধানে এখন কার্যকর ও সমন্বিত পদক্ষেপ জরুরি হয়ে পড়েছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা এ সংকট নিরসনে সরকারি সহযোগিতা প্রত্যাশা করছে, যাতে বাজার দীর্ঘদিনের বোঝা থেকে মুক্ত হয়ে স্থিতিশীল ও বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশে ফিরে যেতে পারে।